ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

বিনামূল্যের বীজে চার হাজার কৃষকের সর্বনাশ

বিনামূল্যের বীজে চার হাজার কৃষকের সর্বনাশ

ফাইল ছবি

রাজবাড়ী ও গোয়ালন্দ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২২:৪১

বিএডিসি থেকে জেলার চার হাজার কৃষককে দেওয়া হয়েছিল পেঁয়াজ বীজ। সেই বীজ বপনের পর অঙ্কুরোদগম হয়নি। এতে এসব কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটিও এর প্রমাণ পেয়েছে। 
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আবারও দেওয়া হবে পেঁয়াজ বীজ। তবে কৃষকরা দাবি করছেন আর্থিক ক্ষতিপূরণের। 
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) রাজবাড়ী জেলা কার্যালয় সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১০ নভেম্বর জেলা সদরে ৮০০, বালিয়াকান্দি উপজেলায় ১ হাজার, পাংশায় ১ হাজার, কালুখালীতে ৮০০ ও গোয়ালন্দ উপজেলায় ৪০০ কৃষকের মধ্যে এসব পেঁয়াজ বীজ বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে তাহিরপুরী বীজ ছিল ২৫ শ কেজি, বারী-৪ ছিল ১১ শ কেজি এবং বারী-১ ছিল চার শ কেজি। সেই সঙ্গে কৃষকদের ১০ কেজি করে ডিএপি ও এওপি সার দেওয়া হয়। কৃষকরা যথারীতি বীজ বপন করেন। সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও চারা গজায়নি। 
বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর রাজবাড়ী জেলা বীজ প্রত্যয়ন কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোহাম্মদ মাছিদুর রহমানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটিও এর সত্যতা পেয়েছে। মোহাম্মদ মাছিদুর রহমান বলেন, বিভিন্ন স্থান সরেজমিনে পরিদর্শন করে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। পেঁয়াজ বীজ গজায়নি এটি তদন্তে পেয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদনের পাশাপাশি কৃষকদের যাতে পুনর্বাসিত করা হয় সে সুপারিশ করা হয়েছে। কীভাবে এর ক্ষতিপূরণ করা যায় সেটি নিয়ে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। 
পাংশা উপজেলার সরিষা ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল কালাম জানান, সরকার থেকে তাদের এক কেজি করে পেঁয়াজ বীজ দিয়েছিল। চার শতাংশ জমিতে বীজ বপন করেছিলেন। এতে খরচ হয়েছিল পাঁচ হাজার টাকা। কিন্তু বীজ থেকে চারা গজায়নি। এ বছর আর জমিতে কোনো ফসল আবাদ করতে পারবেন না। জমি পড়ে থাকবে। যদি আবার পেঁয়াজ বীজ দেওয়া হয় তাতে ক্ষতি পেষাবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, এখন আর পেঁয়াজ বীজ বপনের সময় নেই। আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিলে তাদের জন্য ভালো হতো। 
গোয়ালন্দের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানিয়েছেন, সাধারণত রোপণের এক সপ্তাহের মধ্যে অঙ্কুরোদগম হয়ে থাকে। এ বছর দুই-তিন সপ্তাহ পরও বীজের অঙ্কুরোদগম হয়নি। যারা সরকারি বীজ পেয়েছেন সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এখন বীজ সংকটের কারণে অনেক জমিতে আর পেঁয়াজ রোপণ করা সম্ভব হবে না বলে একাধিক কৃষক জানিয়েছেন।
গোয়ালন্দ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা খোকন উজ্জামান জানান, উপকারভোগী ৪শ কৃষকের মধ্যে বারি-১ জাতের পেঁয়াজ বীজ ৫০ জন কৃষককে সরবরাহ করা হয়। তাদের পেঁয়াজ বীজে মোটামুটি চারা গজিয়েছে। আর বারি-৪ ও তাহেরপুরী পেঁয়াজ বীজ থেকে কোনো চারাই গজায়নি। কৃষি বিভাগ সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ উপজেলার সাড়ে ৩শ কৃষককে বারি-৪ ও তাহেরপুরী পেঁয়াজ বীজ দেওয়া হবে।
রাজবাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) হোসেন শহীদ সরোয়ার্দী বলেন, অতীতে কখনও তাদের এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি। এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে তারা প্রত্যেক কৃষকের পাশে থেকে কাজ করবেন।
বিএডিসি রাজবাড়ী কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক নিপুণ নন্দী বলেন, বিতরণ করা বীজ থেকে চারা কম গজিয়েছে। বীজ উৎপাদনের সঙ্গে তিনটি ইউনিট জড়িত। প্রথমে খামারে কৃষকদের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন করা হয়। এরপর সংরক্ষণ বিভাগে সংরক্ষণ করা হয়। সেখানে ১০ থেকে ১১ মাস সংরক্ষণ করার পর মান যাচাইয়ের পর প্যাকেজিং করে পাঠানো হয়। তাদের এখানে বিতরণের সময় হলে চাহিদা দেওয়ার পর পাঠায়। সেই সময় ৯ নভেম্বর আসার পর ১০ তারিখেই বিতরণ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অভিযোগ পাওয়া যায় বীজ খারাপ। বারি-৪ এবং তাহিরপুরী দুটি জাতের বীজে বেশি সমস্যা হয়েছে। এটি নিয়ে দুটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। তারা সুপারিশ করেছে, এটি কেন খারাপ হয়েছে সেটি নিয়ে কাজ চলছে। দুটির নমুনা পাঠানো হয়েছে। বীজের সমস্যা থাকলে কৃষকদের কীভাবে সহযোগিতা করা যায় সেটি নিয়ে কাজ চলছে। কৃষকদের সাবসিডি দেওয়া হবে এবং সহায়তার জন্য বিকল্প বীজ দেওয়া হবে; যাতে তারা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারেন।  
এক প্রশ্নের জবাবে নিপুণ নন্দী বলেন, বীজ বিতরণের আগে পরীক্ষা করার সুযোগ রাজবাড়ীতে নেই। যেখানে বীজ সংরক্ষণ করা হয় সেখানে ধাপে ধাপে পরীক্ষা করা হয়। বীজ প্যাকেজিং হওয়ার আগে প্রতিটি লট থেকে নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার সময় সন্তোষজনক ছিল। সব প্রক্রিয়া নিয়ম মেনেই করা হয়েছে। এরপরও কেন হয়েছে সেটি তারা গভীরভাবে যাচাই করছেন। 
রাজবাড়ী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শহিদুল ইসলাম বলেন, তারা কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। গত সোমবার জেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সঙ্গে মিটিং করা হয়েছে। কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক। সভায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কীভাবে পুনর্বাসিত করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে আরেকটি সুপারিশ কমিটি গঠন করা হয়েছে। সুপারিশ কমিটির প্রতিবেদন গত মঙ্গলবার জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া হয়েছে। পেঁয়াজ বীজ দিয়েই কৃষকদের পুনর্বাসনের চিন্তা করা হচ্ছে। এখনও সময় আছে পেঁয়াজ বীজ বপনের। 
জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা জানান, এ বিষয়ে দুটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন এখনও এসে পৌঁছেনি। বিষয়টি নিয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে কথা বলেছেন। শিগগির ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের জন্য সুখবর আসতে পারে। 

আরও পড়ুন

×