উদ্যোক্তায় ফিরছে রস-গুড়ের সুদিন

ফাইল ছবি
হাসানউজ্জামান, ফরিদপুর
প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২২:১৯
খেজুর গুড়ের জন্য বিখ্যাত ফরিদপুর অঞ্চল। তবে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছিল সেই ঐতিহ্য। গত চার বছর ধরে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা ও অনলাইনে খাঁটি ও সুস্বাদু প্রাকৃতিক খাবার সরবরাহকারী ফেসবুক পেজগুলোর কল্যাণে ধীরে ধীরে ফিরছে সেই খেজুরের রস আর সুস্বাদু গুড়ের সুঘ্রাণ।
প্রায় এক যুগ বিরতির পর সম্প্রতি বিভিন্ন উদ্যোক্তার হাত ধরে উত্তরাঞ্চল থেকে গাছি ভাড়া করে এনে ফরিদপুরে আবার নব জাগরণ ঘটেছে খেজুর রস ও গুড়ের। করোনাকালে দেশব্যাপী যে অনলাইন সেবার প্রসার ঘটে, তার প্রভাবে ফরিদপুরের খেজুর গুড়ও বিশেষ পণ্য হিসেবে নতুন করে পরিচিতি লাভ করে।
সম্প্রতি ফরিদপুর সদর ও সালথার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গ্রামীণ জনপদে থাকা খেজুর গাছের সুস্বাদু রস সংগ্রহ করতে ব্যস্ত গাছিরা। এবার ফরিদপুরে অন্তত ১০ হাজার খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজ করছেন সহস্রাধিক গাছি। কাকডাকা ভোরে তারা কোমরে খেজুর গাছ চাঁছার সরঞ্জাম ও মাটির হাঁড়ি বেঁধে ছুটে যাচ্ছেন রস সংগ্রহে। এতেও রস ও গুড়ের ব্যাপক চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। ফরিদপুরে এক হাঁড়ি রস ৫০০ টাকা ও এক কেজি গুড় ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
উদ্যোক্তা এনামুল হাসান গিয়াস (৩৫) খেজুর গুড়কে জিআই পণ্য করার দাবি জানিয়ে বলেন, তিনি চার বছর ধরে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে দক্ষ গাছি উচ্চ বেতনে ফরিদপুরে এনে খেজুর গাছ ঝুড়াচ্ছেন। পরিত্যক্ত ও অনাবাদি খেজুর গাছগুলোকে ঝুড়ে ও চেঁছে রস সংগ্রহ করছেন তারা। ফরিদপুরের বিএডিসি বীজ খামার ও সরকারি কৃষি কলেজের দুটি ক্যাম্পাসে তিন শতাধিক খেজুর গাছ ইজারা নিয়ে গাছগুলোকে আবাদের আওতায় এনেছেন। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকেই ফোনে ও অনলাইনে প্রচুর অর্ডার পাচ্ছেন। চাহিদা বেশি হওয়ায় অনেককেই দিতে পারছেন না, অপেক্ষায় রাখছেন। খাঁটি গুড় ৬০০ টাকা কেজির নিচে বিক্রি করলে লাভ থাকে না, তবু ভালো জিনিসের কদর সবসময়ই থাকে।
ফরিদপুর সদর উপজেলার তাম্বুলখানায় বিএডিসি বীজ খামারে গিয়াসের গুড় কিনতে আসা অনলাইন নারী উদ্যোক্তা ফরিদপুর শহরের আলীপুর এলাকার মারিয়া আক্তার জানান, ‘পিওর পার্ক বিডি’ নামের একটি অনলাইন পেজে শিশুখাদ্য বিক্রি করেন তিনি। সেগুলো তৈরির জন্য আট কেজি পরিমাণ গুড় কিনলেন, আরও অর্ডার করলেন পরের সপ্তাহর জন্য। কেমিক্যালমুক্ত প্রাকৃতিক শিশুখাদ্য বানাতে এ গুড় সংগ্রহ করছেন, জানান মারিয়া।
সালথা উপজেলার যদুনন্দী গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, ৩০–৪০ ফুট লম্বা খেজুর গাছে উঠে রস সংগ্রহ করে বাড়িতে আনছেন গাছিরা। সেই রস থেকে সুস্বাদু পাটালি গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি শুরু করেছেন। দামও পাচ্ছেন ভালো। গাছিদের দাবি, রস ও গুড় বিক্রি করে অন্তত ছয় মাস ভালোভাবে চলবে তাদের সংসার। পাশাপাশি আগামী পাঁচ মাসে লাখ টাকা করে আয় হবে প্রত্যেক গাছির।
স্থানীয় গাছি আল আমিন বলেন, তাদের এলাকায় অন্তত তিন শতাধিক খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজ চলছে। কৃষি কাজের পাশাপাশি শতাধিক গাছি রস সংগ্রহের কাজে যুক্ত রয়েছেন। অনেক কষ্ট হয় খেজুরের রস সংগ্রহ করতে। তবে দাম ভালো হওয়ায় কষ্ট আর গায়ে লাগে না। খেজুর গাছগুলো ছোলার কাজ শেষে নল স্থাপনের মাধ্যমে হাঁড়ি পেতে রস সংগ্রহ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে গুড় তৈরি করে তারা বাজারজাতও শুরু করেছেন। দামও ভালো পাচ্ছেন। তিনি আশা করেন, শীত মৌসুমে রস ও গুড় বিক্রি করে আগামী ছয় মাস স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে পারব। সেই সঙ্গে সংসার চালিয়ে প্রত্যেক গাছির লাখ টাকা করে বাড়তি আয় হবে।
সালথার ইউএনও আনিছুর রহমান বালী বলেন, সালথায় এবার অন্তত তিন হাজার খেজুরের গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজ চলছে। তারা গাছিদের একত্রিত করার ব্যবস্থা করছেন। গাছিদের মানসম্মত গুড় তৈরি করে বাজারজাত করার পরামর্শ দেবেন তিনি। পাশাপাশি কেউ যাতে রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে গুড় তৈরি না করে সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করবেন।
কৃষিবিদ আনোয়ার হোসেন বলেন, ফরিদপুরের খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে গত বছর ফরিদপুর সদরে ১০ হাজার খেজুর গাছ রোপণ করা হয়েছে, এবার সে সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। এ ছাড়া অন্য এলাকা থেকে আসা গাছিদের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
- বিষয় :
- খেজুর