ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

অশোধিত চিনি-গুড়ে ‘খাঁটি খেজুর গুড়’

অশোধিত চিনি-গুড়ে ‘খাঁটি খেজুর গুড়’

চারঘাটের পরানপুরে বৃহস্পতিবার ভারতীয় চিনি-গুড় দিয়ে খেজুরের গুড় তৈরির প্রস্তুতি সমকাল

 সনি আজাদ, চারঘাট (রাজশাহী)

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২২:৫৬

‘ভেজাল গুড়ে ভেষজ নির্যাস মেশানোর কারণে আসলের চেয়ে ঘ্রাণ বেশি। বাজারে আসল ও ভেজাল, সব একই দাম। আসল গুড় তৈরি করা কঠিন। এ জন্য রস ও ঝোলা গুড় কেজি হিসেবে কারখানায় বিক্রি করে দিচ্ছি। তারা অগ্রিম টাকা দিয়ে এসব কিনছে।’ কথাগুলো রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার নিমপাড়া গ্রামের আব্দুল কাদেরের।
খেজুরের গুড় তৈরি হলেও তাতে নেই খেজুরের রস। এর উপাদান ঝোলা গুড়, অপরিশোধিত ভারতীয় চিনি ও গুড়, রং, আটা, রাসায়নিক এবং ভেষজ নির্যাস। জেলায় প্রতিবছর গাছের সংখ্যা কমলেও বাড়ছে ভেজাল গুড়ের উৎপাদন। এজন্য চারঘাট, বাঘা ও পুঠিয়ার আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে কারখানা। প্রতিদিন এ গুড় যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এতে রাজশাহীর গুড়ের সুনাম নষ্টের পাশাপাশি বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শীত এলে একশ্রেণির মৌসুমি ব্যবসায়ী কারিগর এনে কারখানা খুলে বসেন। রাতারাতি প্রতিটি কারখানায় ২০০-৩০০ কেজি গুড় তৈরি হয়। গত ১৩ ডিসেম্বর বাঘার আড়ানী দিয়াড়পাড়া গ্রামে অভিযান চালিয়ে এমন ৬০০ কেজি ভেজাল গুড়, নিম্নমানের অপরিশোধিত ভারতীয় চিনি-গুড় ও রাসায়নিক ধ্বংস করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
পাঁচ বছর ধরে অনলাইনে গুড় বিক্রি করেন ওবাইদুর রহমান। তিনি বলেন, আগে রাজশাহীর নাম শুনলেই ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। তবে প্রতারিত হয়ে তারা আগ্রহ হারিয়েছেন। তারা চাষিদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আসল গুড় ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেন। কিন্তু ভেজাল পণ্যের সঙ্গে দামের পার্থক্য থাকায় অনেকে নিতে চান না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চারঘাটে ১ লাখ ৮০ হাজার ২৭৫টি, পুঠিয়ায় পাঁচ লাখ ৭০ হাজার ১২৫ ও বাঘায় ১ লাখ ২০ হাজার ৫১২টি খেজুর গাছ রয়েছে। প্রতিবছর এসব উপজেলায় গড়ে ৪-৬ হাজার গাছ কমছে। এ তিন উপজেলাসংলগ্ন রাজশাহীর সবচেয়ে বড় খেজুর গুড়ের হাট বসে পুঠিয়ার বানেশ্বর বাজারে। প্রতিদিন এ হাটে প্রায় ১০০ থেকে ১১০ টন এবং সপ্তাহে দু’দিন বড় হাটে ১২০ থেকে ১৫০ টন গুড় আসে। 
চারঘাটের বাঁকড়া ও নন্দনগাছী, বাঘার বিনোদপুর, মনিগ্রাম ও আড়ানী এবং পুঠিয়ার ঝলমলিয়া হাটে কেনাবেচা হয়। ভোর থেকে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে এ হাটে পণ্য আনা হয়। 
তবে এসব কী দিয়ে তৈরি হচ্ছে, তা নিয়ে নানান প্রশ্ন ক্রেতাদের। 
সরেজমিন কয়েকটি এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, যত্রতত্র গড়ে উঠেছে কারখানা। টিনের কড়াইয়ে ভারতীয় অপরিশোধিত চিনি ও গুড়ের টিন কেটে টুকরো করা হচ্ছে। কড়াইয়ে দেওয়া হচ্ছে ১০-১২ কেজি ঝোলা গুড়। পরে অপরিশোধিত চিনি ও গুড়ের দলা তাতে মেশানো হচ্ছে। এরপর নির্যাস, রং, রাসায়নিক ও আটা মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘খাঁটি খেজুরের গুড়’। প্রকাশ্যে চলছে এমন কর্মকাণ্ড।
অপরিশোধিত চিনি-গুড় ভারত থেকে আমদানি করা হয় বলে দাবি কারখানা মালিকদের। তাদের ভাষ্য, গত বছর থেকে এসব ব্যবহার করা হচ্ছে। আগে প্রতি মণ গুড় তৈরিতে খেজুরের রস কিংবা ঝোলা গুড়ের সঙ্গে ৫-১০ কেজি চিনি দেওয়া হতো। এখন টিনভর্তি ভারতীয় অপরিশোধিত চিনি-গুড়ের প্রায় ২২ কেজি উপকরণ মেশানো হয়। এর সঙ্গে ১০-১২ কেজি ঝোলা গুড়, আটা ও রাসায়নিক মেশালেই এক মণ গুড় হয়। প্রতি কেজি অপরিশোধিত চিনি-গুড় ৭০-৮০ টাকায় কিনলেও বাজারের খেজুরের গুড় ১৮০-২০০ টাকায় বিক্রি হয়। এতে তিন গুণ লাভ হচ্ছে তাদের।
এসব কারখানায় ভারতীয় অপরিশোধিত চিনি-গুড়ের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় তিন উপজেলার মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠেছে আড়ত। আমদানিকারক চারঘাটের পরানপুর এলাকার মজনু আলী বলেন, মানুষের খাবারের জন্য এসব আমদানি করেন। দেখতে চিনির দলার মতো। কারখানাগুলো এসব কিনে কী করে, সেটা দেখার দায়িত্ব তাদের না।
কারিগররা বলছেন, প্রাকৃতিক কারণে খেজুর গাছে আগের মতো রস হয় না। এতে খাঁটি গুড় তৈরি করা কষ্টসাধ্য। পরিমাণে বাড়াতে অনেকে চিনি মেশান। তাতেও কিছুটা স্বাদ পাওয়া যায়। কিন্তু কারখানা মালিকরা রস ও ঝোলা গুড় কিনে যা তৈরি করছেন, তাতে ঘ্রাণ থাকলেও স্বাদ নেই। এতে আসল গুড়ের কদর কমেছে। এ জন্য বাধ্য হয়ে চাষিরা রস ও ঝোলা গুড় বিক্রি করে দিচ্ছেন।
খেজুর গুড়ে আগের মতো স্বাদ ও গন্ধ নেই জানিয়ে বাঘার মীরগঞ্জ এলাকার গাছি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কারখানাগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারছি না। আমরা ১০ কেজি গুড় তৈরিতেই ক্লান্ত। তারা দিনে ৫-১০ মণ তৈরি করছে। প্রশাসন অভিযান চালালেও পরদিনই চালু হয় কারখানা।’
বানেশ্বর বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী সুফেল রানা। ভেজাল গুড় তৈরির কারণে রাজশাহীর কোটি কোটি টাকার ব্যবসা ক্ষতির মুখে জানিয়ে তিনি বলেন, বাজার বড় হলেও সুনাম হারাতে বসেছে এ অঞ্চলের গুড়। এভাবে চলতে থাকলে রাজধানীসহ বড় বাজারগুলোয় রাজশাহীর গুড় আর চলবে না।
কেমিক্যাল মিশ্রিত গুড় খেলে আলসার, ডায়রিয়া, কলেরাসহ পেটের নানান সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে জানান উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আশিকুর রহমান। শিশুদের খাদ্য তৈরি করে খাওয়ালে কিডনি, হৃদযন্ত্র, ব্রেন ও লিভার ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে বলেও জানান তিনি। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন হাসান বলেন, গাছ কমলেও গুড়ের উৎপাদন বেড়েছে। কারখানাগুলোয় নিম্নমানের সাদা ও লাল অপরিশোধিত চিনি-গুড় মেশানো হচ্ছে। এতে গুনগত মান থাকছে না। এতে প্রকৃত উৎপাদনকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের রাজশাহীর সহকারী পরিচালক বিপ্লব বিশ্বাস বলেন, ভেজাল গুড় তৈরি বন্ধে তিন উপজেলায় অনেক অভিযান চালানো হয়েছে। নতুন কিছু কারখানার তথ্য মিলেছে। সেখানে দ্রুত অভিযান চালানো হবে।

আরও পড়ুন

×