নেই নজর, জবাবদিহি কম, আয়-ব্যয়ে নয়ছয়

ছবি: সমকাল
খুলনা ব্যুরো
প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৪:৫২ | আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৩:২২
খুলনার তেরখাদা উপজেলার ইখড়ি নেবুদিয়া ইসলামিয়া এতিমখানা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৮ সালে। মানুষের দানেই পরিচালিত হতো প্রতিষ্ঠানটি। এটির আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য এতিমখানার সামনে গরুর হাট বসানোর উদ্যোগ নেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সময়ের ব্যবধানে এটাই এখন খুলনা অঞ্চলের অন্যতম বড় গরুর হাট। হাট থেকে গত ১৫ বছরে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব এসেছে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা এবং ইজারাদাররা ফুলেফেঁপে উঠেছেন। কিন্তু যে এতিমখানার জন্য হাট চালু হয়েছিল, সেটি আগের মতোই অর্থ সংকটে রয়েছে। মাত্র একজন শিক্ষক থাকলেও তাঁর বেতন-ভাতা দিতে পারছে না কমিটি। তেরখাদার নেবুদিয়া এতিমখানা একটি উদাহরণ মাত্র। এতিমখানার অর্থ লুটপাট করে প্রভাবশালীদের ফুলেফেঁপে ওঠার ঘটনা অসংখ্য। গ্রাম পর্যায়ে বেশির ভাগ এতিমখানা এক অথবা দুই ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকে। আয়-ব্যয়ের হিসাবও তাদের নিয়ন্ত্রণে। ধর্মীয় আবেগ জড়িত থাকায় এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না মানুষ। জবাবদিহিও করতে হয় না কাউকে। যার কারণে অনেক এতিমখানায় দান করা অর্থের সুষ্ঠু বণ্টন হয় না।
গত ৪ মাসে খুলনার ৫৫টি এতিমখানা ঘুরে এই চিত্রই দেখা গেছে। কেউই সরাসরি হিসাবের খাতা দেখাতে রাজি হননি। কিন্তু অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম দেখে ধারণা করা যায়, আর্থিক খাতে দুর্নীতির আশঙ্কা প্রবল।
ইখড়ি নেবুদিয়া ইসলামিয়া এতিমখানার সভাপতি ছিলেন তেরখাদা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এফ এম অহিদুজ্জামান। আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এতিমখানার সুপার দুই মাস হয়েছে যোগ দিয়েছেন। তিনিও আগের অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে তথ্য দিতে পারেননি।
৫৫টি এতিমখানা ঘুরে দেখা গেছে, সরকারি দুটি এবং বিদেশি দাতা সংস্থা পরিচালিত ছয়টি বাদে অন্য ৪৭টির আয়ের ৮০ ভাগই আসে মানুষের দান থেকে। নগদ টাকা থেকে শুরু করে চাল-ডাল, গরু-ছাগল, কোরবানির পশুর চামড়া এসব প্রতিষ্ঠানে দান করেন মানুষ। গ্রাম পর্যায়ে মাছ, ক্ষেতের সবজিও দান করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া হাট-বাজারে মাইক বাজিয়ে অর্থ সংগ্রহ, দানবাক্স স্থাপনের বিভিন্ন উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করতে দেখা যায় এতিমখানার জন্য।
গোপালগঞ্জ জেলার কয়েকটি মাদ্রাসা ও এতিমখানার দানবাক্স শহরের বিভিন্ন স্থানে ঝুলতে দেখা গেছে। বাক্সের গায়ে লেখা তিনটি ফোন নম্বরই বন্ধ থাকায় তাদের বিস্তারিত পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।
দেখা গেছে, বড় কয়েকটি মাদ্রাসার এতিম ও অসহায় ছাত্রদের জন্য অনুদান সংগ্রহে প্রতিবছর বিদেশে যান পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা। এই প্রক্রিয়াকে ‘কালেকশন’ বলা হয়। সাধারণত মাদ্রাসা ও এতিমখানার ধর্মীয় প্রধানরাই এই কাজে যুক্ত থাকেন। ধর্মীয়ভাবে মর্যাদাগত দিক থেকে তারা উঁচু অবস্থানে থাকা এবং ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় আনার জন্য অনুদানের এসব টাকার বিষয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে সাহস পান না।তাদেরই একটি জামেয়া মিল্লিয়া আরাবিয়া খাদেমুল ইসলাম মাদ্রাসা ও এতিমখানা। এটি পূর্ব বানিয়া খামার লোহারগেট বড় মাদ্রাসা হিসেবে পরিচিত।
প্রতিষ্ঠানের প্রধান মাওলানা শেখ আবদুল্লাহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গিয়ে অনুদান সংগ্রহ করেন। তিনি কওমি শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল কওমিয়া গওহরডাঙ্গার খুলনা অঞ্চলের প্রধান।
আয়-ব্যয় এবং অনুদানের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মাওলানা শেখ আবদুল্লাহ বলেন, প্রায় ৪৫০ থেকে ৫০০ ছাত্র তিন বেলা বোর্ডিংয়ে খায়। ওদের সব খরচ আমরাই চালাই। মানুষের দানেই বোর্ডিং চলে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, সবকিছুতে হিমশিম খাচ্ছি। এর পর কোরবানির চামড়ার দাম পড়ে যাওয়ায় আয়ও অনেক কমে গেছে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশে আমাদের ছাত্র, শুভানুধ্যায়ীরা আছেন। তারা দান করেন, সেই টাকা দিয়ে কোনোমতে চলে। আগে নিজে গিয়ে নিয়ে আসতাম।
এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের আয়-ব্যয়ে হিসাব নিয়মিত অডিট হয় বলে জানান শেখ আবদুল্লাহ। কিন্তু কত টাকা বাইরে থেকে আসে, অডিট প্রতিবেদন পেতে চাইলে তিনি অবিশ্বাস ও সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকান। কথা না বাড়িয়ে কমিটির সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
মাদ্রাসা ও এতিমখানা কমিটির প্রধান শামসুর রহমান বলেন, মাওলানা আবদুল্লাহ সাহেব খুব ভালো মানুষ। তাঁর প্রচেষ্টাতেই মাদ্রাসা ও এতিমখানা এতদূর আসতে পেরেছে। আয়-ব্যয় সম্পর্কে তিনিই দেখাশোনা করেন। আমরা শুধু সহযোগিতা করি।
বেশির ভাগ এতিমখানায় গিয়ে একই ধরনের দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছেন প্রতিবেদক। বড় এতিমখানাগুলো সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন এবং সরকারি অনুদান নেয় না। এ জন্য সরকারি পর্যায়ের কোনো তদারকিও সেখানে নেই।
তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। খুলনার সবচেয়ে বড় মাদ্রাসা জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুমে গিয়ে দেখা গেছে, বোর্ডিংসহ (খাবার) প্রতিটি ব্যয়ের হিসাব রাখা হয়। শিক্ষকরাই এগুলো পরিচালনা করেন, সিনিয়র আলেমরা সেগুলো নজরদারি করেন।
জামিয়া রশিদিয়া গোয়ালখালীর উপাধ্যক্ষ মুফতি আবদুর রহিম বলেন, বোর্ডের পক্ষ থেকে প্রতিবছর অডিট হয়। এই রিপোর্ট বোর্ডের অনুমতি নিয়ে দেখা যাবে।
কুয়েতের দাতা সংস্থা পরিচালিত সুনবুনাহ কমপ্লেক্সেও আয়-ব্যয়ের হিসাব কঠোরভাবে পরিচালনা করতে দেখা গেছে।
সরকারি অনুদানেও নজরদারি কম
খুলনা জেলার ৬৭টি এতিমখানার ১ হাজার ৭৪৩ ছাত্রছাত্রীকে প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা করে অনুদান দেয় সমাজসেবা অধিদপ্তর। এটি ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট নামে পরিচিত। বছরে দুটি কিস্তিতে এতিমখানাগুলোকে এই টাকা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ৬০০ টাকা খাবার, ২০০ টাকা পোশাক এবং চিকিৎসা ও অন্যান্য ব্যয় ২০০ টাকা।
ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট বরাদ্দ ও নীতিমালা, ২০১৫ এর ৭.৯ বিধিতে বলা হয়েছে, আবশ্যিকভাবে প্রতিটি এতিমখানায় বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ চালু করতে হবে এবং সেই কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু অনুদানপ্রাপ্ত ৩৫টি এতিমখানা ঘুরে কওমিভিত্তিক ২৮টিতে বৃত্তিমূলক কোনো প্রশিক্ষণ দেখা যায়নি। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (দাখিল) অধীন সাতটিতে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেয় বলে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন।
এতিমখানাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা এতটাই রুগ্ণ যে, ক্যাপিটেশন গ্র্যান্টপ্রাপ্ত কোনো এতিমখানাই ব্যয় বিভাজন (খাবার ১৬০০, পোশাক ২০০ ও অন্যান্য ২০০) মানে না। এটাকে তারা মোট আয়ের অংশ হিসেবে ধরেই অর্থ খরচ করে। অনুদানপ্রাপ্তির শর্তও মানা হয় না।
নগরীর হাজী আবদুল মালেক ছালেহিয়া এতিমখানায় গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে ছাত্র রয়েছে ২০ জন। এর মধ্যে ১০ জনের প্রতি মাসে ভাতা দেওয়া হয়।
সাত শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছরে একবার পোশাক দেওয়া হয়। সেই পোশাকও কেউ না কেউ দান করেন। চিকিৎসা বা অন্যান্য খাতে ব্যয়ের বিষয়টি তারা জানেন না। প্রত্যেকের পোশাক ছিল জীর্ণ। কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না তাদের।
ক্যাপিটেশন গ্র্যান্টের নীতিমালার বিষয়ে জানতে চাইলে এতিমখানার সুপার তাজুল ইসলাম বলেন, এসব নিয়ম জানা ছিল না। হিসাব রাখা হয়, তবে পুরোপুরি রেজিস্টার মানা কষ্টকর। তিনি বলেন, খাবারসহ প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়ায় এই টাকা দিয়ে মাদ্রাসা পরিচালনা করতে হিমশিম খেতে হয়। এ জন্য বিভিন্ন দান ও সরকারি অনুদানের টাকায় সবার খাওয়া-দাওয়া চলে।
ডুমুরিয়ার শাহ রফিকুজ্জামান এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে গিয়ে দেখা গেছে, তিনটি কক্ষ নিয়ে এতিমখানার অবস্থান। মাত্র একজন শিক্ষক পুরো মাদ্রাসা পরিচালনা করেন। এতিমখানাটিতে ১৮ জন ছাত্রের মধ্যে ৮ জন অনুদান পায়। পুরো টাকাই সবার খাওয়া-দাওয়ার পেছনে ব্যয় হয়। এই মাদ্রাসায়ও কোনো নিয়ম মানতে দেখা যায়নি।
বোর্ডিং সুপার হাফেজ ইমরান হোসেনের বক্তব্যও একই রকম। তিনি বলেন, পুরো এতিমখানা আমি একা, অডিট করবে কে? কেউ দান করলে রেজিস্টারে টাকার অঙ্ক লেখা হয়।
তিনি জানান, পার্শ্ববর্তী মসজিদের খতিব ও ইমাম তিনি। এতিমখানায় কিছু প্রয়োজন হলে জুমার নামাজের আগে গ্রামবাসীর কাছে তুলে ধরেন। তখন গ্রামের মানুষ সবজি, তরকারি, ধান-চাল দিয়ে যান। এগুলো রেজিস্টারে লিখে রাখা কষ্টকর।
ডুমুরিয়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সুব্রত বিশ্বাস বলেন, প্রতি মাসে এতিমখানাগুলো পরিদর্শন করা হয়। আমরা শিক্ষকদের মোটিভেট করার চেষ্টা করি। তাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তর খুলনার উপপরিচালক কানিজ মোস্তফা বলেন, আমি নিজেও মাঝে মাঝে বিভিন্ন উপজেলায় যাই। যদি কোনো উপজেলায় তদারকির ঘাটতি দেখা যায় অথবা কেউ যদি নীতিমালা না মানে, অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
{ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) দুর্নীতিবিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ফেলোশিপ-২০২৪ এর আওতায় প্রতিবেদনটি করা হয়েছে।}
- বিষয় :
- খুলনা
- এতিমখানা
- সমাজসেবা অধিদপ্তর