১০ আগ্রাসনে ধুঁকছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন

.
মামুন রেজা, খুলনা
প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০১:২৪ | আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০৮:৫২
সুন্দরবনকে বলা হয় দেশের রক্ষাকবচ। দশকের পর দশক বঙ্গোপসাগরে উৎপন্ন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে রক্ষা করে আসছে এ বন। তবে মনুষ্যসৃষ্ট কমপক্ষে ১০ ধরনের আগ্রাসনে এখন নিজেই ধুঁকছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বন।
সুন্দরবনের কাছেই গড়ে ওঠা শিল্পকারখানা, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ও রিসোর্টগুলো হয়ে উঠেছে বড় ক্ষতির কারণ। নিয়ন্ত্রণহীন পর্যটন, প্লাস্টিকের দূষণ, বনের মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচল ও পণ্যবাহী জাহাজডুবির ভয়াবহ প্রভাবও পড়ছে। থেমে নেই বিষ দিয়ে মাছ ধরা, মাত্রাতিরিক্ত সম্পদ আহরণ, গাছ কাটা, আগুন দেওয়া ও বন্যপ্রাণী শিকার। সব কিছুর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বনের নদী, মাটি, গাছপালা ও প্রাণীর ওপর।
সুন্দরবনকে রক্ষায় এর চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করেছিল সরকার। গত ১০ বছরে এই এলাকাতে গড়ে উঠেছে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, এলপি গ্যাস প্লান্ট, অয়েল রিফাইনারিসহ প্রায় ৫০টি ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান। বনের খুব কাছে বিশালাকৃতির গুদাম নির্মাণ করেছে খোদ খাদ্য বিভাগ।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, কারখানাগুলোর অপরিশোধিত তরল বর্জ্য সরাসরি ফেলা হয় নদীতে, যা ছোট ছোট খালের মাধ্যমে সুন্দরবনজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে পানি ও মাটিকে দূষিত করছে। এতে বনের অনেক স্থানে আগের মতো চারা গজাচ্ছে না। নদীর পানিতে তেলের পরিমাণ বাড়ায় হুমকিতে পড়েছে জলজ প্রাণী।
এদিকে তীব্র প্রতিবাদ উপেক্ষা করে বনের কাছেই ২০২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর চালু করা হয় রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন সুন্দরবনের ক্ষতির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় পরিচালিত প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) গত সেপ্টেম্বর মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিশোধন ছাড়াই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দূষিত পানি সুন্দরবনের মাইদারা ও পশুর নদে ফেলা হচ্ছে। বর্জ্য ঠিকমতো না ঢেকে করা হচ্ছে পরিবহন। নির্মাণ হয়নি কয়লা রাখার শেড, কোলস্টেক ইয়ার্ড ও অ্যাশ সাইলো। এতে নদীর পানিতে দূষণকারী পারদ, নাইট্রেট ও ফসফেটের পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়েছে।
খুবির অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ধোঁয়া ও নদীতে ফেলা বর্জ্য সুন্দরবনের বড় ক্ষতি করছে।
২৩ রিসোর্টে শব্দ ও আলোকদূষণ
খালের এক পাশে সুন্দরবন, অন্য পাশে রিসোর্ট। বনের এত কাছে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছে ২৩টি কটেজ ও রিসোর্ট। প্রতিটিতে রয়েছে এসি। বিদ্যুৎ না থাকলে চালানো হয় বিকট শব্দের জেনারেটর। রাতে আলোকোজ্জ্বল এসব রিসোর্টে বাজানো হয় সাউন্ড বক্সে গান। এমনকি মাঝেমধ্যে ডিজে পার্টির আয়োজনও থাকে। শব্দ ও এমন তীব্র আলোতে আতঙ্কগ্রস্ত হয় পার্শ্ববর্তী বনের প্রাণী।
এর মধ্যে নির্মাণ করা হচ্ছে আরও সাতটি রিসোর্ট। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী বাবুল হাওলাদার বলেন, এমনিতেই সুন্দরবন বিভিন্ন কারণে বিপদে আছে। এখন নতুন উপদ্রব হয়েছে রিসোর্ট ও কটেজ। পরিবেশ অধিদপ্তর বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক সাদিকুল ইসলাম বলেন, বনের জন্য ক্ষতিকর কটেজ ও রিসোর্ট বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন
সুন্দরবনের বিভিন্ন স্পটে পর্যটকদের যাতায়াত বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। প্রতিবছর সুন্দরবন ভ্রমণে যান গড়ে প্রায় ২ লাখ পর্যটক। তাদের বহনকারী লঞ্চের ইঞ্জিনের শব্দ, হাইড্রোলিক হর্ন, নিঃসৃত তেল ও আলো বনের ক্ষতি করছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এমএ আজিজ বলেন, বনের মধ্যে পর্যটক, জেলে, বাওয়ালি, মৌয়ালদের অবাধ াতায়াত বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের জন্য বড় হুমকি।
জাহাজ চলাচলের পাশাপাশি ডুবছেও বঙ্গোপসাগর থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত সুন্দরবনের মধ্যে ১৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ পশুর নদ দিয়ে জাহাজ চলাচল করে ১৯৫৪ সাল থেকে। এ ছাড়া ১৯৭২ সাল থেকে মোংলা হয়ে সুন্দরবনের মধ্যে কালিঞ্চি, রায়মঙ্গল, কাচিকাটা, আড়পাঙ্গাশিয়া, বজবজা, আড়ুয়া শিবসা, শিবসা ও পশুর নদ দিয়ে ভারতে যাওয়া-আসা করে জাহাজ।
বন বিভাগ জানায়, পশুর নদ দিয়ে প্রতিদিন গড়ে চলাচল করে দেশি-বিদেশি ২২৫টি জাহাজ। অন্য ৭টি নদীতে প্রতিদিন এ সংখ্যা প্রায় ১২০টি। তারা আরও জানায়, গত ১০ বছরে সুন্দরবনের নদীতে অন্তত ২৬টি জাহাজ ডুবেছে। এতে ফার্নেস অয়েল, কয়লা, সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল, পাথর, সারসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে দূষিত হয়েছে নদীর পানি ও মাটি।
খুবির ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, জাহাজের ইঞ্জিনের শব্দ ও হাইড্রোলিক হর্ন বন্যপ্রাণীদের আতঙ্কিত করে তুলছে। এগুলো থেকে নিঃসৃত তেল ও বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে বনের মধ্যে। এতে দূষিত হচ্ছে মাটি ও পানি। এ ছাড়া বনের মধ্য দিয়ে চলাচল করা জলযানের পাখার আঘাতে মারা পড়ছে ডলফিন। নৌযান চলাচল করা রুটগুলোর পাশে এখন আর আগের মতো হরিণ, বানর, পাখিসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী দেখা যায় না।
ভয়াবহ প্লাস্টিক দূষণ
বনের মাটি ও পানিতে উদ্বেগজনক হারে মিলেছে মাইক্রো প্লাস্টিকের উপস্থিতি। এই প্লাস্টিক দূষণ জলজ ও স্থলপ্রাণীর পাশাপাশি গাছের জন্যও ক্ষতিকর।
খুবির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় সুন্দরবনে প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে। ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকায় বিভাগটির স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহাদী হাসানের গবেষণায় বনের ৬টি স্থানের পানি ও মাটি পরীক্ষা করা হয়। মাহাদী জানান, সুন্দরবনে প্রতি লিটার পানিতে গড়ে তিনি ২.২২ আইটেম মাইক্রো প্লাস্টিক পেয়েছেন। প্রতি কেজি মাটিতে এই পরিমাণ গড়ে ৭৩৪ আইটেম।
বাপা মোংলার আহ্বায়ক নূর আলম শেখ বলেন, পর্যটক ও বনজীবীরা যেখানে সেখানে পলিথিন, চিপস, চানাচুর, বিস্কুটসহ বিভিন্ন খাবারের প্যাকেট, পানির বোতল, প্লাস্টিকের কাপ, গ্লাস ও প্লেট ফেলে। এ ছাড়া বন-সংলগ্ন ৮০টি গ্রাম থেকে ৫২টি নদী-খাল হয়ে জোয়ারের পানিতে বনে ছড়িয়ে পড়ছে প্লাস্টিক।
নিয়ম মানেন না বনজীবীরা
অভয়ারণ্য ঘোষিত এলাকা থেকে সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ থাকলেও তা মানে না বনজীবীরা। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে নদী-খালে মাছ ধরে জেলেরা। আবার পাস-পারমিটের তুলনায় গোলপাতা, মাছ ও রেণু পোনা আহরণ করা হয় বেশি।
বন বিভাগ জানায়, অভয়ারণ্যে ঢোকার পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত সম্পদ আহরণের প্রবণতা বেড়েছে। মৌয়ালরা মধু সংগ্রহের জন্য ধোঁয়া দেওয়ার সময় আগুনে পুড়ে মারা যায় অনেক মৌমাছি। অনেকে আবার না বুঝে পুরো মৌচাক কেটে ফেলে। এতে আগের তুলনায় মৌচাক কমে গেছে।
বাঘ ও হরিণ শিকার চলছেই
গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তন-পরবর্তী পরিস্থিতির সুযোগে হরিণ শিকারিরা আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। চোরা শিকারিদের পাশাপাশি বনদস্যুরাও বাঘ ও হরিণ শিকার করে পাচার করছে।
সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, মাঝেমধ্যে হরিণের মাংস এবং হরিণ ও বাঘের চামড়া উদ্ধার হয়। তবে সব ঘটনা প্রশাসনের নজরে আসে না। এ ছাড়া লোকালয়ে চলে আসা বাঘ ও অজগর সাপ পিটিয়ে মারছে মানুষ।
বিষ দিয়ে মাছ শিকার
সহজে মাছ ধরতে সুন্দরবনের মধ্যে ছোট নদী ও খালে বিষ দেয় অসাধু জেলেরা। ভাটা শুরু হলে খাল ও নদীর সংযোগস্থলে বিষ দিয়ে পাতা হয় জাল। এতে পোনা মরার পাশাপাশি মাছের খাবারও ধ্বংস হচ্ছে।
সুন্দরবন একাডেমির উপদেষ্টা রফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, বনের নদী-খালে বিষ দেওয়ায় জলজ প্রাণীর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে এই সর্বনাশ করা হলেও বন বিভাগ তা বন্ধ করতে পারছে না।
গাছকাটা চক্রে হাজারো মানুষ
গভীর বন থেকে অবাধে চলছে গাছকাটা। বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, সুন্দরী, গেওয়া, গরানসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে বিক্রির এ চক্রে জড়িত ১ হাজারের বেশি চোরাকারবারি। বন বিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে এদের সহযোগিতার অভিযোগও রয়েছে। এ ছাড়া জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালরাও সুযোগ পেলে গাছ কেটে নিয়ে যায়। ফলে বনের অনেক এলাকায় কমে গেছে বড় গাছ।
দেওয়া হচ্ছে আগুন
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০০২ সাল থেকে এ পর্যন্ত সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে আগুন লেগেছে কমপক্ষে ২৪ বার। এতে পুড়েছে বনের উল্লেখযোগ্য অংশ।
স্থানীয়রা জানান, বনজ সম্পদ আহরণে যাওয়া বনজীবীদের ফেলে দেওয়া বিড়ি-সিগারেটের আগুন থেকে বনে আগুন লাগে। মধু সংগ্রহের পর মৌয়ালদের ফেলে দেওয়া মশাল থেকেও আগুন লাগে।
বন বিভাগ যা বলছে
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, জিপিএসের সাহায্যে এখন সুন্দরবনে স্মার্ট প্যাট্রোলিং চলছে। বন অপরাধীদের গ্রেপ্তারের জন্য বন বিভাগ, র্যাব, পুলিশ ও কোস্টগার্ড যৌথভাবে কাজ করছে। বন্যপ্রাণী ও বনজ সম্পদ পাচার বন্ধে সুন্দরবনে ঢোকা এবং বের হওয়ার নদী-খালগুলোর মুখে টহল জোরদার করা হয়েছে।
- বিষয় :
- বন