ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

অনলাইনে জুয়া খেলে নীরবে নিঃস্ব

অনলাইনে জুয়া খেলে নীরবে নিঃস্ব

প্রতীকী ছবি

 মাসুম মিয়া, ঘাটাইল (টাঙ্গাইল)  

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৫ | ০১:১৮

‘অনলাইন জুয়া নীরব ঘাতক। ক্যান্সার যেমন জীবনকে ক্ষমা করে না, তেমনি এ জুয়ায় আসক্ত হলে তার ক্ষমা নেই। আমার কষ্টার্জিত ২ কোটি টাকা খোয়া গেছে জুয়ার বাজিতে। মাথায় চেপেছে ২০ লাখ টাকা ঋণের বোঝা। সময়ের ব্যবধান মাত্র দেড় বছর। ছিল কোটিপতির খেতাব, এখন ফকির। কিছুদিন অটোরিকশা চালালেও এখন বেকার। সংসার চলে না।’ কথাগুলো বলার সময় আক্তার হোসেনের (৪২) গলা ধরে আসছিল। বারবার ফেলছিলেন দীর্ঘশ্বাস। তবে অর্থনৈতিকভাবে পড়ে যাওয়ার এই গল্প এখনও তাঁর পরিবারের সদস্যরা জানেন না। এক সময়ের ব্যবসায়ী আক্তারের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল সদর ইউনিয়নে। শুধু আক্তারই নন দিনমজুর থেকে শুরু করে কোটিপতি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, ভ্যানচালকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ অনলাইন জুয়ায় আসক্ত। পিছিয়ে নেই নারীরাও। সরকারের কাছে পর্নোসাইটের মতো এই জুয়ার সাইটও বন্ধের দাবি তুলেছেন এলাকার সচেতন লোকজন। 

অনলাইন জুয়ায় সর্বস্ব হারানো মানুষের  সংখ্যা অনেক। দিন দিন সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। জুয়ার অ্যাপস ডাউনলোড করে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সহজেই অ্যাকাউন্ট খোলা  যায়। অ্যাকাউন্টে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা জমা করে প্রবেশ করা যায় জুয়ার  রাজ্যে। শুরুর বাজিটা অল্প টাকায় হলেও স্বাভাবিকভাবে লোভনীয় বাজিতে বেড়ে যায় টাকার অঙ্ক। মুহূর্তেই ‘লুট’ হয় সব। লাভের গুড় খাওয়া কারও ভাগ্যে হয় না। 
অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সিয়াম হোসেনের বাবা প্রবাসী। স্কুলপড়ুয়া একমাত্র সন্তানের স্মার্টফোনের আবদার ইন্টারনেট সংযোগসহ তার মা বছর দুই আগেই পূরণ করেছেন। ঘুমানোর কক্ষ আলাদা হওয়ায় ছেলের রাতের জগতের বিষয়ে অন্ধকারে তাঁর মা। সিয়ামের ভাষ্য, ১৫ রাতে তার আয় ছিল ৭ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। এই টাকা আসা-যাওয়ার পথ একই। তাই আসার পথেই চলে গেছে লাভসহ আসল। তার দাবি, একসময় জুয়ায় আসক্ত থাকলেও এখন আর সে এ পথে নেই। তবে অনেক ছাত্র এতে আসক্ত। সিয়ামের বাড়ি উপজেলার দেউলাবাড়ি ইউনিয়নে।

যাত্রী না পেলে যেখানে যে অবস্থায় থাকেন মোবাইল নিয়ে জুয়া খেলা শুরু করে দেন বলে জানান অটোরিকশাচালক শহিদুল ইসলাম (২৭)। তাঁর সঙ্গে কথা হয় উপজেলার মাকড়াই এলাকায়। তাঁর ভাষ্য, খেলা রাতেই বেশি হয়। রাত জেগে খেলার কারণে দিনে কাজে মন বসে না। জুয়ার অ্যাকাউন্টে টাকা ফুরিয়ে গেলেই ছটফট শুরু হয়। তখন কোনো কিছুই ভালো লাগে না। কলেজছাত্র সাকিব আল হাসান বলেন, জুয়ার বাজিটা রাতেই বেশি ধরা হয়। মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখ সরানো যায় না। এই খেলায় জড়িতরা একা থাকতে পছন্দ করে। রাত জাগায় মেজাজ থাকে খিটখিটে। লেখাপড়ায় মন বসে না। জুয়ার সফটওয়্যারে যে ‘টিকটিক টিকটিক’ শব্দ দেওয়া আছে, তা ঘুমের মধ্যেও কানে বাজে বলে জানান দিনমজুর রফিকুল ইসলাম (২৯)। তাঁর দাবি এ শব্দ রক্তে মিশে গেছে। 

দেওপাড়া ইউনিয়নের সৌদি আরব প্রবাসীর স্ত্রী রমিছা খাতুন (২৭)। তিনি বলেন, ‘যখন বাজি ধরি, তখন হার্ট চরম পর্যায়ে লাফালাফি শুরু করে। কি না কি হয়। এ পর্যন্ত আমার অনেক টাকা ক্ষতি হয়েছে।’ 
জুয়ায় অনেকেই সর্বস্ব হারিয়ে ঋণ নিচ্ছেন এনজিও ও ব্যাংক থেকে। ঋণের টাকায়ও ধরছেন বাজি। অন্যের কাছ থেকে দৈনিক উচ্চ সুদে টাকা নিয়েও জুয়ায় মাতছেন। শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, রাত জাগার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শারীরিকভাবেও। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ ডা. সিয়াম আল ইসলাম সমকালকে বলেন, আমাদের জৈবিক কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জরুরি হলো ঘুম। একজন সুস্থ মানুষের প্রতিদিন রাতে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। ঘুমের মাধ্যমেই আমাদের শরীরে সারাদিনে উৎপন্ন বিষাক্ত পদার্থ পরিষ্কার হয়, প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা হয়। চিকিৎসা পরিভাষায় একে বলা হয় সারকাডিয়ান রিদম। এটি শুধু রাতের ঘুমের সময়ে হয়ে থাকে। রাতে না ঘুমানোর ফলে শরীরে স্ট্রেস হরমোনের (কর্টিসল) মাত্রা বেড়ে যায়, যার ফলে অতি অল্প বয়সেই ডায়াবেটিস হতে পারে। রাতে ঘুমের অভাবে শরীরের বিপাকীয় ক্রিয়ায় যে বিষাক্ত পদার্থ উৎপন্ন হয়, তা শরীর থেকে বের হতে পারে না। এতে শরীরের রক্তনালির ভেতরে প্রদাহের কারণে চর্বি জমে সরু হয়ে যায়, যা উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। এ ছাড়া ঘুমের অভাব অনিয়মিত হৃদস্পন্দন (অ্যারিদমিয়া) এবং স্মৃতিভ্রংশ (ডিমেনশিয়া) রোগের জন্য দায়ী।

অনলাইন জুয়া বন্ধে আইসিটি বিষয়ে অভিজ্ঞ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, দেশে অনলাইন জুয়া একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা, যা তরুণ সমাজকে আসক্ত করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতি ডেকে আনছে। এটি বন্ধ করতে ডিপ প্যাকেট ইন্সপেকশন (ডিপিআই) প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পাঠানো ডেটা পর্যবেক্ষণ এবং অবৈধ কার্যক্রম শনাক্ত করে ব্লক বা রি-রাউট করতে পারবে। এ ছাড়া বিটিআরসি ও আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিশালী ওয়েব ফিল্টারিং ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন, যাতে জুয়ার ওয়েবসাইট ও অ্যাপগুলোতে প্রবেশ বন্ধ করা যায়। যেহেতু মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জুয়ার টাকা লেনদেন হয় এবং জুয়ার প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে থাকে, তাই এটা পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। এ ছাড়া জুয়ায় সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট ও অ্যাপ চিহ্নিত করে তাদের ডোমেইন এবং আইপি ব্লক করা অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা হতে পারে। এতে ব্যবহারকারীদের এসব প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হবে এবং জুয়ার বিস্তার কমাতে সাহায্য করবে।
টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গোপালপুর সার্কেল) ফৌজিয়া হাবিব খান সমকালকে বলেন, অনলাইন জুয়া নিয়ে পুলিশের সাইবার টিম মাঠে কাজ করছে। ঘাটাইল এবং গোপালপুরের ক্ষেত্রে অনলাইন জুয়াটাকে বিশেষভাবে দেখা হচ্ছে। যখনই এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য আসছে, তখনই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই। 


 

আরও পড়ুন

×