ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

জেগে ওঠে নতুন নতুন চর, চলে দখলের মহোৎসব

জেগে ওঠে নতুন নতুন চর, চলে দখলের মহোৎসব

.

সৌরভ হাবিব, রাজশাহী

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৫ | ০১:০৩ | আপডেট: ১৭ মে ২০২৫ | ১০:০৫

রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধের দক্ষিণে পদ্মা নদী। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই বাঁধের ভেতরের জমি খাস হলেও অনেকেই নিজের দাবি করে দখলে নিয়েছেন। ব্যক্তিমালিক ছাড়াও রাজশাহী সিটি করপোরেশন সেখানে গড়ে তুলেছে বাণিজ্যিক স্থাপনা। ইচ্ছামতো ভরাট করার কাজ চলছে প্রতিনিয়ত। দখল ছাড়াও দূষণের গ্রাসে বিবর্ণ পদ্মা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড দুই বছর আগে নগরীর তালাইমারী থেকে হরিরামপুর পর্যন্ত ৫৩৫ দখলদার চিহ্নিত করে তাদের উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে তালিকা পাঠিয়েছে। তবে এ পর্যন্ত একজনকেও উচ্ছেদ করা হয়নি। ভারতে ফারাক্কা বাঁধ দেওয়ার পর থেকে নদীর ধারা শীর্ণ হয়ে এসেছে। জেগে উঠেছে নতুন নতুন চর। সেই সঙ্গে চলছে দখলের মহোৎসব।

নগরীর সিঅ্যান্ডবি মোড়ের দক্ষিণে একটি রেস্তোরাঁ ও পিকনিক কর্নার ভাড়া নিয়ে পরিচালনা করছেন মাসুদ রানা নামের একজন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রানা বলেন, তিনি ৩০ হাজার টাকা মাস হিসেবে জায়গাটি ভাড়া নিয়েছেন জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান ডালিমের কাছ থেকে। রেস্তোরাঁর পাশেই হাঁটছিলেন ডালিম।

জানতে চাইলে ডালিম বলেন, ‘আমার নানার সূত্রে ৪২ বিঘা জমি আমরা পেয়েছি। এই জমির সিএস, এসএ খতিয়ানের মালিক আমার নানা। আরএস খতিয়ানে সরকার খাস করে ফেলে। এই খাস সংশোধনের জন্য সরকারের সঙ্গে মামলা করছি। সরকার বলছে, এটি নদীর খাসজমি। আমরা মামলা করে স্থগিতাদেশ এনে ব্যবসা করছি। আরএস খতিয়ান সংশোধন হলে আমাদের পক্ষে রায় হবে।’

শহর রক্ষা বাঁধের দক্ষিণে নিজের জমি কীভাবে হয়– জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে শহর রক্ষা বাঁধ আরও নিচে ছিল। পরে ওপরে এসেছে। তখন হয়তো খাজনা দেওয়া হয়নি। তাই খাস করা হয়েছিল ভুল করে।

ডালিমের দখল করা জমির পাশে আরও দুটি রেস্তোরাঁ বিশাল এলাকাজুড়ে। শতবর্ষী বিভিন্ন গাছও রয়েছে সেখানে। সেগুলোতে নানা রঙের বৈদ্যুতিক বাতি ঝোলানো হয়েছে। চোখ ধাঁধানো সাজ। ‘সিক্স ফোরটি’ রেস্তোরাঁয় মিজানুর রহমান তিতাস নামের এক কর্মচারী বলেন, রবিউল, রনি, হান্নান, দীপ্তসহ কয়েকজন মিলে এটি করেছেন। রবিউল রাজনীতি করেন। অন্যরা ব্যবসায়ী। তাদের নম্বর চাইলে দেওয়ার অনুমতি নেই বলে জানান তিতাস।

সিক্স ফোরটির পাশে ‘কাবাব সাইল’ রেস্তোরাঁয় শাহাদত হোসেন নামের এক কর্মচারী বলেন, শাওন, সায়েম ও আলমগীর এ রেস্তোরাঁ করেছেন। তাদের ফোন নম্বর চাইলে দিতে রাজি হননি শাহাদত। স্থানীয়রা জানান, এ দুটি রেস্তোরাঁর জমির মালিক দাবিদার মো. সুপার।

তাঁর ফোন নম্বর সংগ্রহ করে দেখা করতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সাক্ষাতের সময় হবে না।’ জমি প্রসঙ্গে ফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পৈতৃক সূত্রে এই জমি পাওয়া। আগে শহর রক্ষা বাঁধ আরও নিচে ছিল। পরে ওপরে হয়েছে। জমির সিএস ও এসএ খতিয়ান আমার পূর্বপুরুষের নামে। আরএস খতিয়ানে জমি খাস দেখানো হয়। এর বিরুদ্ধে মামলা করেছি।’

এসব রেস্তোরাঁর আশপাশে বিশাল এলাকাজুড়ে পদ্মার জমি দখল করার প্রতিযোগিতা চলছে। জমি দখল করে বিনোদন কেন্দ্র তৈরি করে তা লিজ দিয়েছে রাজশাহী সিটি করপোরেশন। সেখানে নোঙর নামে একটি রেস্তোরাঁ চলছে। বিশাল এলাকা ঘিরে বিনোদন কেন্দ্র করা হয়েছে। এ ছাড়া আছে সম্মেলন কেন্দ্র, রেস্তোরাঁ ও কফিশপ। ইট-সিমেন্ট দিয়ে স্থায়ী ভবনও আছে চরে। 

এদিকে শহরের ড্রেনের সব পানি পদ্মা নদীতে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, নগরীর বড় বড় স্থাপনা তৈরির কংক্রিটসহ বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে। আলুপট্টি এলাকার বিশাল অংশজুড়ে বর্জ্য ফেলে বেশ কিছু অংশ উঁচু করে দখল করা হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে কয়েকটি রেস্তোরাঁ। এদিকে পদ্মাপারে শত শত হকার প্লাস্টিক ও পলিথিনের প্যাকেটে খাবার বিক্রি করেন বেড়াতে আসা মানুষের কাছে। এসব পলিথিন শেষ পর্যন্ত যাচ্ছে নদীতে। 

নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘শহর রক্ষা বাঁধের দক্ষিণে পুরোটাই পদ্মা। এখানে কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকতে পারে না। এমন দখলদার সবখানেই আছে। তাদের উচ্ছেদ করবে সরকার– এটিই আমাদের প্রত্যাশা।’ 

রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান অঙ্কুর বলেন, ‘পদ্মা দখল হচ্ছে। আমরা ৫৩৫ দখলদার চিহ্নিত করে দুই বছর আগে জেলা প্রশাসকের কাছে তালিকা পাঠিয়েছি উচ্ছেদ করার জন্য। আশা করছি, প্রশাসন শিগগিরই ব্যবস্থা নেবে।’

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মির্জা ইমাম উদ্দিন বলেন, ‘কিছু মানুষ সিএস ও এসএ খতিয়ান এনে পদ্মাপারের জমি নিজেদের দাবি করছে। এসব খাসজমি। সরকার তাদের সঙ্গে মামলা চালিয়ে যাচ্ছে। আদালত যে রায় দেবেন, সেটিই বাস্তবায়ন হবে। এ ছাড়া আরও কিছু মানুষ জমি দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা করেছে। জেলা প্রশাসন তাদের চিহ্নিত করেছে। শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে।’

আরও পড়ুন

×