ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

১০% টাকার জন্য ঝুঁকিতে আট হাজার কোটির প্রকল্প

১০% টাকার জন্য ঝুঁকিতে আট হাজার কোটির প্রকল্প

কোলাজ

 আব্দুল্লাহ আল মামুন, চট্টগ্রাম 

প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৫ | ০১:০৩ | আপডেট: ১৯ মে ২০২৫ | ১০:৫৬

পাহাড় ও টিলাবেষ্টিত নগর চট্টগ্রাম। সামান্য বৃষ্টি হলেই পানির সঙ্গে পাহাড়ি বালু-মাটি নেমে ভরাট হয় খাল ও নালা। নগরজুড়ে দেখা দেয় তীব্র জলাবদ্ধতা। দীর্ঘদিনের এ সমস্যা থেকে রেহাই পেতে বাস্তবায়ন হচ্ছে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প। কথা ছিল পাহাড়ি বালু-মাটি আটকাতে ২৭টি সিল্টট্র্যাপ (বালু আটকানোর ফাঁদ) নির্মাণ হবে। তবে সরকারি বরাদ্দ না পাওয়ায় ১২টি সিল্টট্র্যাপ নির্মাণ থেকে সরে আসছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। শুধু সিল্টট্র্যাপ নয়, গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ৮৭১ কোটি টাকার কাজ বাদ দিতে যাচ্ছে সংস্থাটি। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাজগুলো বাদ দেওয়া হলে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের স্বপ্ন ফিকে হয়ে যাবে। প্রকল্পের পূর্ণ সুফল মিলবে না। মাত্র ১০ শতাংশ (৮৫৬ কোটি) টাকার জন্য পুরো প্রকল্পের সুফলই না মেলায় ঝুঁকি তৈরি হবে। কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বর্ধিত ব্যয়ের ৮৫৬ কোটি টাকা সিডিএর তহবিল থেকে দিতে বলেছে সরকার। তবে সিডিএর এত টাকা ব্যয়ের সামর্থ্য নেই। তাই কিছু কাজ বাদ দেওয়া ছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই।

জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চট্টগ্রাম নগরে খাল রয়েছে ৫৭টি। এর মধ্যে ৩৬টি খাল ঘিরে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০১৭ সালে অনুমোদিত প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। তবে তড়িঘড়ি করে নেওয়া প্রকল্পটি অনুমোদনের আগে সম্ভাব্যতা যাচাই (ফিজিবিলিটি স্টাডি) করা হয়নি। ফলে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে নানা বিপত্তিতে পড়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এরপর ২০১৮ সালে পূর্ণাঙ্গ ফিজিবিলিটি স্টাডি করায় সেনাবাহিনী। এতে প্রকল্পটির নকশা ও ব্যয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ২০২৩ সালে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) এক লাফে ৩ হাজার ১০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ে। ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকার প্রকল্পটিতে ইতোমধ্যে ৭৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

সিডিএ সূত্র জানায়, প্রথমে বর্ধিত ব্যয়ের দেড় হাজার কোটি টাকা দিতে রাজি হয় সরকার। বাকি দেড় হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৭৫৩ কোটি টাকা সরকারি ঋণ ও ৭৫৩ কোটি টাকা সিডিএর নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয়ের শর্তে সংশোধিত প্রকল্পটি অনুমোদন হয়। তবে আর্থিক সংগতি না থাকায় ২০২৫ সালের শুরুতে প্রকল্প কাটছাঁট করার প্রস্তাব দেয় সিডিএ। এরপর ২৭ মার্চ অর্থ বিভাগের চিঠিতে বলা হয়, দেড় হাজার কোটি টাকার মধ্যে সরকার আরও ৬৫০ কোটি টাকা দেবে। বাকি ৮৫৬ কোটি টাকার মধ্যে ১০৩ কোটি টাকা সরকারি ঋণ এবং বাকি ৭৫৩ কোটি টাকা সিডিএর নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করতে হবে। তবে সিডিএ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটির আয় ও ব্যয় প্রায় সমান। তাদের এত টাকা ব্যয়ের সামর্থ্য নেই।  

এ বিষয়ে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘৮৫৬ কোটি টাকা খরচের সামর্থ্য সিডিএর নেই। তাই টাকাটা সরকারি অনুদান হিসেবে পেতে প্রকল্প পুনর্গঠন করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আমরা আশা করছি, সরকার প্রকল্পটির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে পুরো টাকাটা অনুদান হিসেবে বরাদ্দ দেবে। বরাদ্দ না মিললে প্রকল্পের কাজ কাটছাঁট করতে হবে।’

বাদ যেতে পারে যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ
যাচাই-বাছাই করে প্রকল্পটির প্রায় ৮৭১ কোটি টাকার গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাদ দেওয়ার খসড়া করেছে সিডিএ। এর মধ্যে রয়েছে– ২৮৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ১২টি সিলট্র্যাপ নির্মাণ, ৩৬৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন খালে প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ, ১৫৮ কোটি ৩২ লাখ টাকায় সড়কের পাশে থাকা নালার সম্প্রসারণ, বিদ্যমান নালা পরিষ্কার ও মেরামতে ৩১ কোটি ৭১ লাখ টাকা এবং ১৯ কোটি ৮৪ টাকায় নতুন নালা নির্মাণ, ১০ কোটি টাকায় খালের পাড়ে পাঁচ ফুট চওড়া ফুটপাত নির্মাণ এবং ৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে সড়কবাতি স্থাপনের কাজ।  

প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বর্ষায় খাল-নালা ভরাটের অন্যতম কারণ পাহাড় থেকে বৃষ্টির পানির সঙ্গে গড়িয়ে আসা বালু। এই বালু ঠেকাতে প্রকল্পটিতে ২৭টি সিলট্র্যাপ নির্মাণের কথা ছিল। বরাদ্দ না পাওয়ায় ১২টি সিলট্র্যাপ নির্মাণ বাদ দেওয়া হচ্ছে। ফলে বর্ষায় খাল-নালা ভরাট রোধ করা যাবে না। এতে জলাবদ্ধতা সমস্যা থেকেই যাবে। এ ছাড়া নালা সংস্কার ও নতুন নালা নির্মাণ না হলে বর্ষায় জমে থাকা পানি খালে যেতে পারবে না। খালগুলোতে প্রতিরোধ দেয়াল এবং পাড়ে ফুটপাত নির্মাণ করা না হলে পুনরায় তা দখল হয়ে সংকুচিত হয়ে পড়বে। এতে পানি চলাচল বাধাগ্রস্ত হবে।
জানতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ‘প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বড়জোর নগরের ৪০ শতাংশ জলাবদ্ধতা নিরসন হবে। এর মধ্যে যদি প্রকল্প আরও কাটছাঁট করা হয় তাহলে এই হার আরও কমবে। সরকারের উচিত এই টাকা অনুদান হিসেবে বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ কাজ বাস্তবায়ন করা।’

আরও পড়ুন

×