ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

এইখানে এক খাল ছিল

এইখানে এক খাল ছিল

চট্টগ্রাম নগরের কালিরছড়া খাল দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে আবাসন প্রকল্পসহ নানা স্থাপনা। কিছু অংশে খাল তিন-চার ফুট থাকলেও অধিকাংশ স্থানে নিশানা পর্যন্ত নেই খালটির। সম্প্রতি তোলা সমকাল

আহমেদ কুতুব, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৫ | ০১:৩৬ | আপডেট: ২৫ মে ২০২৫ | ০৯:৫৯

চট্টগ্রাম নগরের কালিরছড়া খাল দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে হাউজিং। কিছু অংশে খাল তিন-চার ফুট থাকলেও অধিকাংশ জায়গায় নিশানা পর্যন্ত নেই বিএস রেকর্ডের ২৫ ফুট প্রস্থ খালটির। আর সাগরপ্রান্তে প্রস্থ ঠেকেছে সাত থেকে আট ফুট।

নগরীর আকবর শাহ এলাকায় খালের জমিতে ‘লেকসিটি হাউজিং’ প্রকল্প করেছে খোদ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। ইতোমধ্যে তারা চারটি প্লট তৈরি করেছে। পাশেই ভরাট করা খালের ওপর ঝুলছে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের সাইনবোর্ড। প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য খালটি দখল করে ৩১টি আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন এবং ছোট-বড় শতাধিক টিনশেড স্থাপনা করা হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী বর্ণ হক বলেন, ডিজিটাল সার্ভেতে খাল দখল করে সিটি করপোরেশনের হাউজিং প্রকল্প, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লটসহ শতাধিক অবৈধ স্থাপনার তথ্য উঠে এসেছে। অধিকাংশ স্থানে বিএস রেকর্ড অনুযায়ী খালটি নালায় পরিণত হয়েছে। অনেক স্থানে আবার খালের কোনো অস্তিত্বই নেই।

পানি উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রাম-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ বলেন, কালিরছড়া খাল পুনরুদ্ধারে পাউবো ২৬০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ১১ মে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান কার্যালয়ে জমা দিয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে এটি মন্ত্রণালয়ে যাবে। আশা করছি, খালটি খনন ও দখলমুক্ত হলে শহরের উত্তরাঞ্চল বন্যামুক্ত থাকবে।

চসিকের এস্টেট অফিসার কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমাদের লেকসিটি প্রকল্প কারও খাল দখল কিংবা ভরাট করে হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড বিএস রেকর্ড ধরে সার্ভে করার কারণে অনেক ভুলত্রুটি রয়েছে এ জরিপে। আরএস রেকর্ড ধরে সার্ভে করলে ত্রুটি হতো না। যৌথ সার্ভে না করলে এ সমস্যার সমাধান হবে না।

এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ডেপুটি রেজিস্ট্রার সানাউল করিম চৌধুরী জানান, লেকসিটির কাছাকাছি তাদের একটি জায়গা আছে। কিন্তু সেটি খাল দখল করে করা কিনা, তা তিনি জানেন না।

সরেজমিন গত বৃহস্পতিবার আকবর শাহ থানার বিশ্ব কলোনির লেকসিটি হাউজিং প্রকল্পে দেখা যায়, কালিরছড়া খালটি দুই পাশ থেকে দখল করে ইটের দেয়াল দেওয়ায় নালায় পরিণত হয়েছে। খালের উৎসমুখ ধ্বংস করে তিনটি প্লট ও সিটি করপোরেশনের হাউজিংয়ের রাস্তা করা হয়েছে। পাশেই খালের ওপর আবদুর রহিম নামে এক ব্যক্তির তিনতলা ভবন। খালের মধ্যে দেয়াল দিয়ে মাটি ভরাট করে ভবনটি করেছেন তিনি।

আবদুর রহিম বলেন, ‘অন্যজন থেকে খালের পাশে তিন গণ্ডা জমি কিনে ভবন তৈরি করেছি। খালের কোনো অংশ দখল কিংবা ভরাট করিনি। এটি তো নালা, খাল কখনও ছিল না।’

বিশ্ব কলোনি এলাকায় একতলা ভবন ও টিনশেড চারটি বাড়ি রয়েছে। এভাবে ৩১টি আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন এ খালের ওপর নির্মাণ করেছে দখলদাররা। পাউবোর ডিজিটাল জরিপে উঠে এসেছে, কালিরছড়া খালের ওপর পাঁচতলা ভবন ১, চারতলা ভবন ৩, তিনতলা ভবন ৪, দোতলা ভবন ৫, একতলা ভবন ৬, সেমিপাকা বাড়ি ৬ ও টিনশেডের ৬টি বাড়িই খাল দখল করে করা। এর বাইরে গড়ে তোলা হয়েছে অর্ধশত ছোট স্থাপনা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সবচেয়ে বেশি দখল হয়েছে বিশ্ব কলোনি, সিটি গেট, কৈবল্যধাম ও লতিফপুর অংশে। বিএস রেকর্ড অনুয়ায়ী, লেকসিটি এলাকায় খালের প্রস্থ ১৮ দশমিক ৫ ফুট থাকলেও এখন বাস্তবে রয়েছে তিন থেকে চার ফুট। বিশ্ব কলোনি এলাকায় খালটি ১৬ ফুট চওড়া থাকলেও এখন ৪ থেকে ৬ ফুট, সিটি গেট এলাকায় ২৬ ফুটের স্থলে ৫ থেকে ৭, লতিফপুরে ২৯ ফুটের জায়গায় এখন দৃশ্যমান রয়েছে ৬ থেকে ৮ ফুট।

দখলে মৃতপ্রায় কালিরছড়া খালে প্রাণ ফেরাতে তৎপর পাউবো। সাড়ে ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের খালটির উৎপত্তিস্থল লেকসিটি ডাইভারশন পাহাড়ি এলাকায়। এখান থেকে বিশ্ব কলোনি, ইউনিলিভার, দক্ষিণ সলিমপুরের মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের পাশ দিয়ে লতিফপুরে ১ ভেন্ট রেগুলেটর গিয়ে শেষ হয়েছে। এখান থেকে আরও এক কিলোমিটার খাল বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে মিশে গেছে। সাড়ে চার কিলোমিটার মূল খাল। বাকি এক কিলোমিটার লতিফপুর থেকে সাগরে মিশেছে।

খালটি খনন না করায় পাহাড়ি মাটি ও বালুতে অনেক স্থান ভরাট হয়ে গেছে। ডিজিটাল জরিপ শেষে খালটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ২৫ ফুট প্রস্থ করে তিন ফুট গভীর খনন কাজ করার সুপারিশ করা হয়েছে। খালের উভয় পাশে ১৬ মিটার করে রিটেইনিং ওয়াল করার উদ্যোগ নিয়েছে পাউবো।

খাল খননে ১২ কোটি টাকা, রিটেইনিং ওয়াল তৈরিতে ২১০ কোটি, শূন্য দশমিক ২ হেক্টর জমি অধিগ্রহণে ২৫ কোটি, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে এক কোটি, প্রজেক্ট ভবন তৈরিতে ১২ কোটি টাকার খাল পুরুজ্জীবিতকরণ প্রকল্প তৈরি করে সরকার থেকে ২৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

×