ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

মৎস্য প্রজনন

হালদাপাড়ে হাসির ঝিলিক

হালদাপাড়ে হাসির ঝিলিক

ফাইল ছবি

তৌফিকুল ইসলাম বাবর, চট্টগ্রাম 

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫ | ২৩:৩২ | আপডেট: ৩১ মে ২০২৫ | ০৯:৫৯

মেঘের তর্জন-গর্জন, মুহুর্মুহু বজ্রপাত, ভারী বর্ষণ, আর পাহাড়ি ঢল। মা মাছের ডিম ছাড়ার জন্য এমন পরিবেশ দরকার। এবার ঘটেছে তাই। অনুকূল পরিবেশে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র চট্টগ্রামের হালদায় ডিম ছেড়েছে কার্প জাতীয় মা মাছ। কয়েক বছর ধরে মা মাছ সমানতালে ডিম ছাড়ছিল না। গত মৌসুমে তো তেমন ডিম পাওয়া যায়নি। ফলে হালদার পোনা সংগ্রহকারীদের মধ্যে ছিল হতাশা। এবার বিপুল পরিমাণে ডিম পাওয়ায় তাদের মুখে হাসি ফুটছে। প্রাথমিক হিসাবে সংগ্রহ করা ডিমের পরিমাণ ১৪ হাজার কেজির বেশি।

আগে থেকে ডিম সংগ্রহের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন সংগ্রহকারীরা। পরিবেশ-প্রকৃতি দেখে তারা বুঝে যান– মা মাছ ডিম ছাড়বে। ফলে জাল, বালতিসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে নৌকায় করে হালদায় নেমে পড়েন তারা। এক পর্যায়ে তাদের উৎকণ্ঠার অবসান ঘটে। মধ্যরাতে ডিম ছাড়তে থাকে মা মাছ। শুরু হয় ডিম সংগ্রহের উৎসব। প্রতিযোগিতা দিয়ে চলে সংগ্রহের কার্যক্রম। গতকাল শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত তিনশ নৌকা নিয়ে মাছের ডিম সংগ্রহ করেন তারা।

বিশেষজ্ঞ, মৎস্য অফিস ও ডিম সংগ্রহকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উত্তর চট্টগ্রামের হালদার মদুনাঘাট ছায়ার চর থেকে রামদাস মুন্সির হাট, আজিমের ঘাট, মাচুয়াগোনা, কাগতিয়া, আইডিএফ হ্যাচারি, সিপাহীঘাট, নোয়াহাট, কেরামতলীর বাঁক ও অঙ্কুরিঘোনা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। এখন নদীর পাড়ে স্থাপিত সরকারি ও বেসরকারি হ্যাচারি এবং ট্র্যাডিশনাল মাটির কুয়াগুলোতে ডিম পরিস্ফুটনে ব্যস্ত সময় পার করছেন পেশাদার সংগ্রহকারীরা। শুরু থেকে ডিম সংগ্রহের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নৌ পুলিশ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি।

হালদা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে আসছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মন্জুরুল কিবরিয়া। তিনি সমকালকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে আশানুরূপ ডিম পাওয়া যাচ্ছিল না হালদায়। গত মৌসুমে তো তেমন কোনো ডিম পাওয়া যায়নি। এবার ১৪ হাজার কেজির বেশি ডিম পাওয়া গেছে। এটি বড় সুখবর।’ তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে ডিম ছাড়তে শুরু করে মাছ। ডিম পাওয়ায় আমরা নতুন করে আশার আলো দেখছি। সংগ্রহকারীরাও তো দারুণ খুশি।’

হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘রাত ২টার দিকে জোয়ারের সময় হালদার আমতুয়া অংশে কার্পজাতীয় মা মাছ পুরোদমে ডিম ছাড়ে। পরে ডিমগুলো হালদার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। যারা প্রথম দিকে ডিম সংগ্রহ করতে নদীতে ছিলেন, তারা বেশি পেয়েছেন। সংগ্রহকারীরা গড়ে আড়াই বালতি করে ডিম সংগ্রহ করেছেন।’

হালদার সিপাহীঘাট কুম এলাকার প্রবীণ ডিম আহরণকারী মো. ইদ্রিস বলেন, ‘আমরা বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে নদীতে অবস্থান করি। রাত ২টার দিকে ডিম ছাড়ে মা মাছ। আমি দুই থেকে তিন বালতি ডিম সংগ্রহ করেছি। এর আগে ২০০ গ্রাম নমুনা ডিম সংগ্রহ করি।’

সংগ্রহকারী মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমরা নদীতে ১০টি নৌকা নিয়ে ডিম সংগ্রহ করি। প্রতিটি নৌকায় গড়ে দুই থেকে আড়াই বালতি করে ডিম পেয়েছি। রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ মাছের ডিম রয়েছে।’ হালদার ডিম আহরণকারী সমিতির সভাপতি মো. শফিউল আলম জানান, ছয়টি নৌকা ও দুটি বাঁশের ভেলায় ১৩ বালতি ডিম সংগ্রহ করেছেন তিনি। 

সমকালের রাউজান সংবাদদাতা প্রদীপ শীল জানান, শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে ডিম সংগ্রহ করে দুই পারের মানুষ। রাউজান উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন বলেন, প্রথমে দুই দফা নমুনা ডিম ছাড়ে মাছ। রাতে পুরোদমে ডিম ছাড়ে। রাউজান ও হাটহাজারী অংশে ৭০০ ডিম সংগ্রহকারী তিন শতাধিক নৌকা নিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে ডিম সংগ্রহ করেন।

সমকালের হাটহাজারী সংবাদদাতা মো. মহিন উদ্দিন জানান, বংশপরম্পরায় ডিম সংগ্রহ করেন হালদা পারের সংগ্রহকারীরা। তারা রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ মাছের ডিম সংগ্রহ করে সরকারি হ্যাচারি, মাটি ও সিমেন্টের কুয়ায় রেণু ফোটাবেন। এ কাজে সময় লাগবে চার দিন। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া এসব রেণুর পোনা দ্রুত বড় হয় বলে এটি সারাদেশের মাছচাষিদের প্রথম পছন্দ। তাই দামও থাকে বেশি।

ডিম ছাড়ার পর ক্লান্ত মা মাছগুলোকে যাতে কেউ শিকার করতে না পারে, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হালদায় বাড়তি লোকবল নিয়োগ করে নজরদারিতে রেখেছে। এজন্য কাজ করছে স্থানীয় প্রশাসনও। 

হাটহাজারীর গড়দুয়ারার ডিম সংগ্রহকারী কামাল উদ্দিন সমকালকে বলেন, ‘এবার ভালো ডিম সংগ্রহ হয়েছে। চার দিন পর রেণু ফুটবে। দীর্ঘদিন পর লাভের মুখ দেখবেন ডিম সংগ্রহকারী ও হ্যাচারি মালিকরা।’ 

হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে কিছু নমুনা ডিম ছাড়া আর কোনো ডিম ছাড়েনি মা মাছ। ২০২৩ সালে কমবেশি ১৪ হাজার কেজি ডিম পাওয়া যায়। এর আগে ২০২২ সালে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কেজি ও ২০২১ সালে সাড়ে ৮ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়। ২০২০ সালে হালদায় রেকর্ড ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম পাওয়া গিয়েছিল। 

আরও পড়ুন

×