ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা

মুরাদনগরে আবার নৃশংসতা

মুরাদনগরে আবার নৃশংসতা

কুমিল্লার মুরাদনগরের কড়ইবাড়ি গ্রামে বৃহস্পতিবার হামলায় গুরুতর আহত রুমা আক্তারকে অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাঁর মা, ভাই ও বোনকে কুপিয়ে-পিটিয়ে হত্যা করেছে একদল মানুষ -সমকাল

 কুমিল্লা ও মুরাদনগর প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫ | ০১:৫৫ | আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২৫ | ১০:০৭

একটি মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে ছেলেমেয়েসহ মাকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করেছে একদল মানুষ। এ সময় গুরুতর আহত হয়েছে এক মেয়ে। কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানাধীন কড়ইবাড়ী গ্রামে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে এ ঘটনা ঘটে।

নিহতরা হচ্ছেন– জুয়েল মিয়ার স্ত্রী রোকসানা আক্তার রুবি (৫৮), তাঁর ছেলে মো. রাসেল (৩৫) ও মেয়ে জোনাকি আক্তার (৩২)। হামলায় আহত হয়েছেন রুবির আরেক মেয়ে রুমা আক্তার (২৫)। তাঁকে সংকটাপন্ন অবস্থায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
কড়ইবাড়ী গ্রামের মানুষের অভিযোগ, নিহত রোকসানার পরিবার দুই দশকের বেশি সময় ধরে মাদক কারবারে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে থানায় মাদক-সংক্রান্ত একাধিক মামলা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তাদের ওপর এলাকাবাসীর ক্ষোভ ছিল। গত মঙ্গলবার মোবাইল ফোন চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় একটি পক্ষ এই পরিবারের বিরুদ্ধে এলাকাবাসীকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে।

ঘটনা যেভাবে শুরু
গত মঙ্গলবার বিকেলে স্থানীয় শিক্ষক রুহুল আমিনের একটি মোবাইল ফোন চুরি হয়। চোর সন্দেহ করা হয় রুবির মেয়ের জামাই মনির হোসেনকে। এ ঘটনায় গতকাল সকালে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য বাচ্চু মিয়া এবং আকাবপুর ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল ওই বাড়িতে যান। রুবিকে ফোন ছিনতাই বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন। তাদের ওপর উল্টো হামলা করা হয় বলে দু’জন অভিযোগ করেন। চেয়ারম্যান এবং ইউপি সদস্য দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। শিমুল বিল্লাল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

এক পক্ষের অভিযোগ, বোরহান উদ্দিন ওরফে মারুফ নামের এক তরুণ ফোনটি চুরি করেন। এই তরুণ রুবির মেয়ে জোনাকির স্বামী মনির হোসেনের সঙ্গে কাজ করেন। তাঁর বাড়ি উপজেলার হায়দরাবাদ এলাকায়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, রুবির খুচরা মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করেন বোরহান।
শিক্ষকের মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগ এনে মঙ্গলবার আকাবপুর ইউপির ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বাচ্চু মিয়া ও স্থানীয় বাছির উদ্দিনের নেতৃত্বে বোরহানকে মারধর করা হয়। খবর পেয়ে বোরহানকে ছাড়িয়ে নিতে যান রুবি। সেখানে বাচ্চু-বাছিরসহ অন্যদের সঙ্গে রুবি ও তাঁর পক্ষের লোকজনের বাগ্‌বিতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়। এ ঘটনাকে ঘিরে পরদিন বুধবারও দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এসব নিয়ে দুই পক্ষে উত্তেজনা চলছিল। গতকাল সকালে কড়ইবাড়ী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আসেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল ও ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়া।

 এ সময় তাদের সঙ্গে রুবি ও তাঁর মেয়েদের বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে ইউপি সদস্য বাচ্চুকে চড় দেন রুবি। এর পরই রুবির বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা ইউনুছ মিয়া বলেন, চেয়ারম্যান রুবির বাড়ি থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পর এলাকার মসজিদের মাইকে চেয়ারম্যান ও মেম্বারের ওপর হামলার কথা জানিয়ে লোকজন জমায়েত করা হয়। প্রায় দেড় হাজার লোক লাঠিসোটা নিয়ে রুবির বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। দু’জনকে পিটিয়ে হত্যা করে মরদেহ বাড়ির সামনে ফেলে রাখে। অন্য একটি গ্রুপ বাড়ির অদূরে রাস্তায় রুবির ছেলে রাসেলকে পিটিয়ে হত্যা করে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে রুবির আহত মেয়ে রুমাকে উদ্ধার করে সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করে। এ সময় একটি কক্ষে লুকিয়ে থেকে রক্ষা পান রুবির স্বামী জুয়েল ও নিহত রাসেলের স্ত্রী মিনি আক্তার।

নিহত তিনজন  রোকসানা আক্তার রুবি  মো. রাসেল ও জোনাকি আক্তার

মিনি আক্তার সমকালকে বলেন, একই এলাকার শরীফ, বাছির, রফিক, রবিউল আউয়াল ও জিলানীর নেতৃত্বে কয়েকশ লোক বাড়িতে হামলা চালায়। সন্তানদের নিয়ে তিনি একটি কক্ষে আশ্রয় নেন। পরে র‍্যাব এসে তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, এলাকার কয়েকশ লোক ঘটনাস্থলে সমবেত। বাড়ির সামনে পড়ে ছিল তিনজনের মরদেহ। পাশাপাশি তিনটি ভবনের প্রতিটিতে হামলা ও ভাঙচুরের চিহ্ন দেখা গেছে।
উপস্থিত লোকজন জানায়, মাইকে চেয়ারম্যান-মেম্বারের ওপর হামলার খবর পেয়ে কড়ইবাড়ী, পীরকাসিমপুর, মেটাংঘর, হিরাকাসিসহ আশপাশের লোকজন দ্রুত ঘটনাস্থলে আসে।

সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
আকাবপুর ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল বলেন, মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের একটি ঘটনা নিয়ে আমি ও ইউপি মেম্বার বাচ্চু জিজ্ঞেস করতে গেলে আমাদের ওপর প্রথমে হামলা চালায়। সম্মান বাঁচাতে স্থান ত্যাগ করি। পরে গ্রামবাসী খবর পেয়ে ওই বাড়িতে গিয়ে হামলা চালায়। এ সময় আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। পরে জানতে পেরেছি, রুবি, তাঁর ছেলে এবং মেয়ে নিহত হন। তবে এমন হত্যাকাণ্ড কোনোভাবে কাম্য নয়।

বাঙ্গরা বাজার থানার ওসি মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, গণপিটুনিতে তিনজন ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছেন। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে আহত রুমা আক্তার ও পরিবারের সদস্যদের উদ্ধার করেছে। কয়েক গ্রামের লোক এ হামলায় জড়িত। নিহতের পরিবার উদ্যোগ না নিলে পুলিশ মামলা করবে।
কুমিল্লার পুলিশ সুপার নাজির আহমেদ খান সমকালকে বলেন, যাদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তারা অপরাধী হয়ে থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিতে পারত। কিন্তু আইন হাতে তুলে নিয়ে যারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তদন্ত করে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

ক্ষুব্ধ মানবাধিকারকর্মীরা
তিনজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দ্রুত, নিরপেক্ষ ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো পৃথক বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়।
এমএসএফের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের সই করা বিবৃতিতে বলা হয়, কথিত এ পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘদিন মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এ নিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে তাদের বিরোধ ছিল। অথচ এদের আইনের হাতে সোপর্দ না করে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এটা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ এবং মানবিক মর্যাদায় আঘাত ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। গণপিটুনি বা মব বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। তাই মব বা গণপিটুনির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

আসকের পরিসখ্যান অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত গণপিটুনির ঘটনায় ৯৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। সংস্থার সিনিয়র সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবিরের সই করা বিবৃতিতে বলা হয়, এ ঘটনায় জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তিকে দ্রুত শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। একটি নিরপেক্ষ, প্রমাণনির্ভর ও সঠিক তদন্তের মাধ্যমে মামলা প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করে জড়িতদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি পরিবারটির গুরুতর আহত সদস্যের নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও আইনি সহায়তা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিশ্চিত করতে হবে।

 


 

আরও পড়ুন

×