লাউড়ের দুর্গ এখন সংরক্ষিত পুরাকীর্তি

পঙ্কজ দে, সুনামগঞ্জ
প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | ১৩:৩১
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার লাউড় রাজ্যের রাজধানীর দুর্গকে সংরক্ষিত
পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে এই প্রত্নতত্ত্বস্থলটি হয়েছে
সরকারি তালিকাভুক্তও। গত ২৫ সেপ্টেম্বর এই প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপনাকে
সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় সংরক্ষিত ঘোষণা করে।
গত বছরের ১৪ নভেম্বর থেকে তাহিরপুর উপজেলার লাউড় রাজ্যের রাজধানীর দুর্গ
খননের প্রাথমিক কাজ শুরু করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।
এ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. আতাউর রহমান
খনন কাজ শুরুর পর বলেছিলেন, 'তাহিরপুরের লাউড়ে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক
নিদর্শন পাওয়া গেছে, যেটি কয়েক যুগকে যুক্ত করবে।'
ইতিহাস পর্যালোচনায় পাওয়া যায়, প্রাচীনকাল থেকে শ্রীহট্ট (সিলেট) কয়েকটি
খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ত্রৈপুর রাজবংশের অধ্যুষিত স্থান ত্রিপুরা রাজ্য
বলে সাধারণত কথিত হয়। এই রাজবংশের অধিকার একসময় বরবক্রের সমস্ত বাম তীর
পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
শ্রীহট্টের তিন ভাগ তিনজন পৃথক নৃপতি দ্বারা শাসিত হতো। গৌড়, লাউড় ও
জয়ন্তিয়া এই তিন খণ্ডের নৃপতির অধীন ছিলেন আরও অনেক ক্ষুদ্র ভূমি মালিক।
লাউড় রাজ্য ছিল সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলার কিয়দংশ পর্যন্ত
বিস্তৃত। লাউড় ছিল একটি স্বাধীন রাজ্য। তাহিরপুরের সীমান্ত এলাকায় লাউড়ের
রাজধানী ছিল। এই রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ হলহলিয়া গ্রামে এখনও বিদ্যমান। এই
রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কেশব মিশ্র। তারা ছিলেন কাত্যান গোত্রীয় মিশ্র।
তাদের উপাধি ছিল সিংহ। খ্রিষ্টীয় দশম অথবা একাদশ শতকে তিনি কনৌজ থেকে এখানে
আসেন। দ্বাদশ শতকে এখানে বিজয় মাণিক্য নামের নৃপতি রাজত্ব করতেন। কারও
কারও মতে, বঙ্গ বিজয়ের পর রাঢ় অঞ্চল মুসলমানদের হাতে চলে যাওয়ায় সেখানকার
বিতাড়িত ও পরাজিত সল্ফ্ভ্রান্তজনরা প্রাণ ও মান বাঁচানোর জন্য চারদিকে
ছড়িয়ে পড়িয়েছিলেন। তাদেরই একজন এখানে এসে রাজত্ব গড়ে তোলেন। রাঢ় শব্দ হতেই
লাউড় শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। লাউড় রাজ্যের রাজধানী লাউড়
ছাড়াও জগন্নাথপুর ও বানিয়াচংয়ে আর দুটি উপরাজধানী ছিল।
ঐতিহাসিক ডব্লিউ হান্টারের মতে, সম্ভবত ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে লাউড় রাজ্য
স্বাধীনতা হারায় এবং মোগলরা এর নিয়ন্ত্রক হন। লেখক সৈয়দ মূর্তজা আলী তাঁর
রচিত 'হযরত শাহ্জালাল ও সিলেটের ইতিহাস' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, মোগল
সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.) লাউড়ের রাজা গোবিন্দ সিংহ তাঁর
জ্ঞাতি ভ্রাতা জগন্নাথপুরের রাজা বিজয় সিংহের সঙ্গে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে
বিরোধে লিপ্ত হয়েছিলেন। এর জের ধরেই বিজয় সিংহ গুপ্ত ঘাতকের হাতে নিহত হন।
তার বংশধররা এ হত্যার জন্য গোবিন্দ সিংহকে দায়ী করে তার বিরুদ্ধে মোগল
সম্রাট আকবরের রাজদরবারে বিচার প্রার্থনা করেন। এ ঘটনার বিচারের জন্য
সম্রাট আকবর সৈন্য পাঠিয়ে গোবিন্দ সিংহকে দিল্লিতে ডেকে নেন। বিচারে
গোবিন্দ সিংহের ফাঁসির হুকুম হয়। গোবিন্দ সিংহের অন্য নাম ছিল জয় সিংহ। একই
সময়ে জয় সিংহ নামের অন্য এক ব্যক্তি রাজা গোবিন্দ সিংহের সঙ্গে সম্রাট
আকবরের কারাগারে আটক ছিল। ভুলবশত প্রহরীরা গোবিন্দ সিংহের পরিবর্তে ওই জয়
সিংহকে ফাঁসিতে ঝোলান। গোবিন্দ সিংহের প্রাণ এভাবে রক্ষা পাওয়ায় তিনি কৌশলে
সম্রাট আকবরের কাছ থেকে নানা সুযোগ গ্রহণ করেন। প্রাণভিক্ষা চান তিনি এবং
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। গোবিন্দ সিংহের নাম হয় হাবিব খাঁ। সম্রাট আকবর
গোবিন্দ সিংহকে তার হূতরাজ্য পুনরায় দান করেন। অবশ্য শর্ত দেওয়া হয় হাবিব
খাঁ সম্রাট আকবরের বশ্যতা স্বীকার করবেন এবং সম্রাটের খাজনার পরিবর্তে ৬৮
খানা কোষা নৌকা নির্মাণ করে সম্রাটকে সরবরাহ করবেন। এই নৌকাগুলো খাসিয়াদের
আগ্রাসন থেকে আত্মরক্ষার জন্য মোগল ও স্থানীয় বাহিনী কর্তৃক রণতরী হিসেবে
ব্যবহার করা হবে। প্রাচীন নানা গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে হাবিব খাঁর পৌত্র
ছিলেন মজলিস আলম খাঁ। মজলিস আলম খাঁর পুত্র ছিলেন আনোয়ার খাঁ। তিনি
খাসিয়াদের উৎপাতের কারণে সপরিবারে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের লাউড় ছেড়ে
হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে চলে যান এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন।
এই বংশেরই উমেদ রাজা লাউড়ে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। এই দুর্গের
ধ্বংসাবশেষই লাউড়ের হাউলী, হলহলিয়া বা হাবেলী নামে পরিচিত। বর্তমানে এই
দুর্গের ভগ্নাবশেষ দেখা যায়। প্রতিটি প্রকোষ্ঠের কারুকার্য দেখলে যে কেউ
মনে করবেন, এখানে সল্ফ্ভ্রান্ত কোনো রাজা বা নৃপতি বাস করতেন। প্রাচীন এই
স্থাপনা ক্রমেই ধ্বংসের পথে ছিল।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, 'হাওরাঞ্চলের প্রাচীন
নিদর্শন লাউড় রাজ্য ঐতিহাসিক স্থাপনার স্বীকৃতি এবং সরকারের প্রত্নসম্পদের
তালিকাভুক্ত করায় এখানকার জেলা প্রশাসক হিসেবে আমি খুশি। খনন ও গবেষণায়
সাধ্যমতো সহযোগিতা করব। আমি মনে করি, এখানকার পুরাকীর্তি পর্যটন বিকাশের
সহায়ক হবে।'
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড.
আতাউর রহমান জানালেন, সুনামগঞ্জের লাউড় রাজ্যের এই ঐতিহাসিক স্থাপনার
স্বীকৃতি এবং সরকারের প্রত্নসম্পদের তালিকাভুক্ত করার জন্য সবচেয়ে বেশি
প্রচেষ্টা ছিল সুনামগঞ্জের কৃতী সন্তান বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের
চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিকের। এখন এই প্রত্নসম্পদের কেউ কোনো ক্ষয়ক্ষতি
করতে পারবে না। ওখানে খনন ও গবেষণা চলবে। উন্মুক্ত জাদুঘর করার জন্য যা যা
প্রয়োজন, সবই করা হবে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হান্নান মিয়া বলেন, 'এই ঐতিহাসিক
দুর্গটি সরকারের প্রত্নসম্পদের তালিকাভুক্ত হওয়ায় সুনামগঞ্জ তথা সিলেট
অঞ্চলের প্রত্নপর্যটন বিকাশের ধারা উন্মোচিত হলো।'
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ডক্টর মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল এনডিসি
বলেন, 'এমন ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনকে সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক
মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষিত পুরাকীর্তির
তালিকাভুক্তির কাজটি সম্পাদন করতে পেরে সন্তুষ্টিবোধ করছি। ওই স্থানকে ঘিরে
আরও বেশি গবেষণাধর্মী কাজ করার সুযোগ তৈরি হলো এবং হাওরাঞ্চলে
প্রত্ন-পর্যটনেরও সম্ভাবনা তৈরি হলো।'
বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান কবি ও গবেষক ড. মোহাম্মদ সাদিক
বলেন, 'সিলেটের প্রাচীন ইতিহাসের অনেকাংশই এই অঞ্চলে বিদ্যমান রয়েছে,
এখানে সঠিকভাবে গবেষণা করতে পারলে এই অঞ্চলের সঠিক ইতিহাস পুনরুদ্ধার করা
সম্ভব হবে, যা সিলেটের ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোগ হবে। এই প্রত্নস্থলটি
সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত হওয়ায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, সংস্কৃতিবিষয়ক
মন্ত্রণালয়সহ সংশ্নিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা পোষণ করছি। এ প্রত্নস্থলটি
সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত হওয়ায় সঠিকভাবে নিরবচ্ছিন্ন গবেষণার মাধ্যমে
এখানকার প্রাচীন পটভূমি জানা যাবে এবং এই অঞ্চলে প্রত্নপ্রেমী ও
প্রত্ন-পর্যটন বিকাশ হবে।'