ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য 'বীর নিবাস'

অসচ্ছল তালিকায় সচ্ছলরাও!

অসচ্ছল তালিকায় সচ্ছলরাও!

অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে তালিকায় স্থান পেয়েছেন জহুরা আখতার। অথচ তিনি গাজীপুরের নয়নপুরে তার স্বামী প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হকের দেড় বিঘা জমির ওপর নির্মিত এই বাড়িতেই বসবাস করেন- সমকাল

ইজাজ আহ্‌মেদ মিলন, গাজীপুর

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২০ | ১৫:২১

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ঘেঁষে কোটি টাকা মূল্যের জমির ওপর মার্কেট, মহাসড়কের পাশে অন্তত আড়াই কোটি টাকা মূল্যের জমির ওপর কাঁচা-পাকা বাড়ি এবং পৈতৃক ভিটায় রয়েছে আরও একটি বাড়ি। দুই বাড়িতে অন্তত ৩০টি কক্ষে ভাড়াটেরা বাস করেন। এত সম্পত্তি থাকার পরও সরকারি খাতায় তিনি অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী!

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে মুজিববর্ষ উদযাপনের আওতায় সরকার অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন নির্মাণ নামে একটি প্রকল্প নিয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় বাড়িগুলোর নাম হবে 'বীর নিবাস'। নিজেকে অসচ্ছল দাবি করে সেই প্রকল্পে ১৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত একটি বাড়ি নেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন শ্রীপুরের মাওনা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত আজিজুল হকের স্ত্রী জহুরা আখতার। যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটি ৩২ জন অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার চূড়ান্ত তালিকায় তার নাম ৫ নম্বরে সুপারিশ করেছে।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা জহুরা আখতার বলেন, তিনি মোটেও অসচ্ছল নন, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের সরকার বাড়ি নির্মাণ করে দেবে- এ খবর জানার পর তিনি একটি আবেদন করেছিলেন। দেওয়া না দেওয়ার ব্যাপার তো সরকারের কাছে। তিনি আরও বলেন, তার নামে সামান্য জমি আছে, বাকিগুলো তার সন্তানদের নামে।

মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হকের ছেলে রফিকুল ইসলাম বলেন, বাবা তার সব সম্পত্তি মৃত্যুর আগে ছেলেমেয়েদের নামে লিখে দিয়ে গেছেন। পৈতৃক সূত্রেই তার বাবা বেশ সম্পদশালী। সেই সূত্রে তারা বেশ ভালো আছেন। বাবার দুই সংসারে আমরা তিন ভাই, পাঁচ বোন।

দুই মায়ের নামে তেমন কিছু নেই। তারা এখনও মাটির ঘরেই বাস করেন।

স্থানীয়রা জানান, শ্রীপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার ও যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য সিরাজুল হকের ভাইয়ের স্ত্রী এই জহুরা আখতার। এক্ষেত্রে কোনো স্বজনপ্রীতি হয়েছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখারও অনুরোধ করেছেন অন্য মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যরা। শুধু জহুরা আখতারই নন, শ্রীপুর উপজেলা থেকে সুপারিশ করে পাঠানো নামের তালিকায় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান, সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারসহ কয়েকজন সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নাম এসেছে। এ নিয়ে অন্যসব মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের মধ্যে চলছে নানা তর্ক-বিতর্ক।

ওই তালিকার ২ নম্বরে রয়েছে সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আ জ ম এনামুল হকের নাম। স্থানীয়রা বলছেন, তিনি মোটেও অসচ্ছল নন। পৈতৃক সূত্রেই তিনি বেশ সচ্ছল। তবে এই মুক্তিযোদ্ধার দাবি, তিনি এখন অসচ্ছল।

আ জ ম এনামুল হক বলেন, পৈতৃক সূত্রে তিনি ১৭-১৮ শতাংশ জমির মালিক। মাটির ঘরে বাস করেন। কাওরাইদ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম ফকিরের নামও চূড়ান্ত ওই তালিকায় রয়েছে। স্থানীয়রা বলেন, এক সময় তিনি বেশ সম্পদশালী ছিলেন। এখন তেমন কিছু নেই। কাওরাইদ ইউপি চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আজিজুল হক বলেন, সাবেক এই চেয়ারম্যানকে দেওয়া সঠিক হয়েছে।

আক্তাপাড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা জুবেদ আলী বলেন, গঠিত কমিটির সদস্যরা সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করেই এ তালিকা প্রস্তুত করেছেন। এখানে স্বজনপ্রীতি করা হয়েছে। মাসে কয়েক লাখ টাকা বাসা ভাড়া পায় এমন মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্যের নামও ওই তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

বারতোপা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মাস্টার মামুন বলেন, তার চেয়ে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা অন্তত শ্রীপুর উপজেলায় নেই। তিনিই তো এ তালিকায় নেই। স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে এই তালিকা প্রস্তুত করার সময়। অনেক সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার নাম এসেছে তালিকায়।

স্বজনপ্রীতি করে নিজের ভাইয়ের স্ত্রীকে ওই তালিকায় রেখেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য ও সাবেক উপজেলা কমান্ডার সিরাজুল হক বলেন, না কোনো স্বজনপ্রীতি করা হয়নি। এটা তো প্রথম ধাপ। পর্যায়ক্রমে সব মুক্তিযোদ্ধাকেই সরকার বাড়ি করে দেবে। প্রত্যেকেই বাড়ি পাবেন।

শ্রীপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মনজুরুল ইসলাম বলেন, পুরো উপজেলা থেকে ১৪৩টি আবেদন পেয়েছিলেন। পাঁচ সদস্যের কমিটির যাচাই-বাছাই, সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও সরেজমিনে মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি পরিদর্শন শেষে ৩২ জনকে চূড়ান্ত সুপারিশ করে জেলায় পাঠানো হয়েছে। সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নামও ওই তালিকায় রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়েছেন তারা।

জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, এ বিষয়ে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে বিষয়টি ফের যাচাই-বাছাইয়ের জন্য উপজেলা কমিটিকে নির্দেশ দেওয়া হবে। উপজেলা কমিটির পাঠানো তালিকাই চূড়ান্ত তালিকা। জেলা পর্যায়ে এ-সংক্রান্ত কোনো কমিটি নেই।

এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সমকালকে বলেন, এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে সেটা গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হবে। তদন্তে যদি নীতিমালা ভঙ্গের সত্যতা পাওয়া যায়, তাহলে চূড়ান্ত তালিকা থেকে ওই নাম বাদ দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

×