'এই রইম্যা জাগা আঁরার কাছে স্বপ্নের মতো'

শুক্রবার নোয়াখালীর ভাসানচরে নতুন আবাসস্থলে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গারা - প্রতিবেদক
বিশেষ প্রতিনিধি, ভাসানচর থেকে
প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০২০ | ২৩:২৬
'বদ্দা এ রইম্যা জাগাত থাকন আঁরার কাছে স্বপ্নের মতো।' রোহিঙ্গা ভাষায় মো. জলিল ভাসানচরের মাটিতে এমন অনুভূতি প্রকাশ করেন। এরপর আরও যা বললেন তার অর্থ হলো- জলিলের কল্পনাতেও ছিল না ঝকঝকে তকতকে এমন পরিবেশ তাদের জন্য তৈরি করে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ঘর দেখে রীতিমতো অভিভূত তিনি। এরপর বললেন- নিজ দেশে ফিরতে চান তারা। যতদিন বাংলাদেশে থাকবেন ততদিন ভাসানচরেই থাকতে চান। ছয় সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে ভাসানচরে এসেছেন জলিল। ক্লাস্টার হাউসের সামনে তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। জলিল ছাড়াও আরও অন্তত ৫ জন রোহিঙ্গার অনুভূতি জানতে চাওয়া হয়েছিল।
তারা সবাই ভাসানচরের পরিবেশ দেখে খুশি। মাজেদা বেগম নামে আরেক রোহিঙ্গা জানান, ভাসানচর আসার আগে জায়গাটির অনেক গল্প শুনেছি। ইউটিউবে দেখেছি। এছাড়া টেলিভিশনের খবরে ভাসানচরের দৃশ্য দেখেছি। তবে এখানে এসে যা দেখছি তা সত্যি দারুণ।
একগুচ্ছ স্বপ্ন নিয়ে ভাসানচরে আসা আরেকজন হলেন হাছিনা বেগম। তিনি জানান, কুতুপালং ক্যাম্পের পরিবেশ অনেক নোংরা। ভাসানচরে এসে দেখেন পুরো উল্টো। ছিমছাম সুন্দর পরিবেশ। এছাড়া কক্সবাজারের ক্যাম্পে প্রায়ই গন্ডগোল হয়। মারামারি হলে সন্তানরা ভয় পায়। রোহিঙ্গারা নিজেদের মধ্যে প্রায়ই সংঘাতে লিপ্ত হয়। এসব ঝামেলা থেকে দূরে থাকতেই ভাসানচরে এসেছেন তিনি।
রাবেয়া খাতুন নামে আরেক রোহিঙ্গা জানান, ক্যাম্পের অনেক মাঝি ভাসানচর সম্পর্কে অনেক ভালো খবর দিয়েছিল। এখানে এসে দেখি তাদের কথা পুরোপুরি সত্য। অন্য যারা কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে রয়েছে তাদের অনেকের ভাসানচর সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা নেই।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভাসানচরে নিজেদের বসতভিটা বুঝে পাওয়ার পরপরই অনেকে নিজের ঘর বারবার ঘুরে ঘুরে দেখেন। শিশুরা খোলা জায়গা পেয়ে এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে।
ভাসানচরে এরই মধ্যে তৈরি করা হয়েছে এক হাজার ৪৪০টি ক্লাস্টার হাউস ও ১২০টি শেল্টার স্টেশন। গুচ্ছগ্রামের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে এসব ক্লাস্টার হাউস। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসে ১২টি গৃহ। প্রতি গৃহে রয়েছে ১৬টি কক্ষ। একেক কক্ষে চারজন থাকার ব্যবস্থা থাকায় রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের তুলনায় ভাসানচরে বেশ ভালোভাবে বসবাস করতে পারবে। প্রথম দফায় গতকাল যে রোহিঙ্গারা ভাসানচরে এসেছে তাদের ৭-১০ নম্বর শেল্টার হাউসে রাখা হয়েছে।
নয়নাভিরাম ভাসানচর :অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ভূমি থেকে চার ফুট উঁচুতে রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য প্রতিটি ক্লাস্টার হাউস ও শেল্টার স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ক্লাস্টারে বসবাসকারীরা যাতে দুর্যোগকালীন আশ্রয় নিতে পারে, সে জন্য রাখা হয়েছে একটি শেল্টার স্টেশন। যেখানে স্বাভাবিক সময়ে ২৩টি পরিবার বসবাস করতে পারবে। প্রতিটি ক্লাস্টারে পুরুষ ও নারীর জন্য আলাদা গোসলখানা এবং টয়লেটের ব্যবস্থা আছে। ক্লাস্টার হাউসে রয়েছে রান্না করার সুব্যবস্থাও। ভাসানচরের শেল্টার স্টেশনগুলো স্টিল ও কংক্রিটের কম্পোজিট স্ট্রাকচারে তৈরি। বাস্তুচ্যুত হিসেবে রোহিঙ্গাদের সব ধরনের নাগরিক সুবিধা ভাসানচরে রয়েছে।
ভাসানচরের এই প্রকল্পে রয়েছে চারটি ওয়্যারহাউস। প্রতিটি ক্লাস্টারের সঙ্গে রয়েছে একটি পুকুর। অগ্নিনির্বাপণের কাজেও পুকুরের পানি ব্যবহার করা যাবে। এখানে আছে এক মেগাওয়াট হাইব্রিড সোলার প্যানেল, প্রয়োজনীয় পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন লাইন, একটি এক মেগাওয়াট জেনারেটর, দুটি ৫০০ কিলোওয়াটসহ মোট তিনটি ডিজেল জেনারেটর। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ থেকে দ্বীপটিকে সুরক্ষার জন্য ২ দশমিক ১ কিলোমিটার 'স্কিন ব্রেকওয়াটারের' মাধ্যমে 'শোর প্রটেকশনের' ব্যবস্থা হয়েছে। মালপত্র ও জনবল চলাচলের সুবিধার জন্য প্রয়োজনীয় পন্টুন ও বোট ল্যান্ডিং সাইটের কাজও শেষ।
এই প্রকল্পের প্রতিটি ব্যারাক ঘরে রয়েছে পৃথক সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা। প্রতিটি শেল্টারে পাঁচ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আলাদা সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা রয়েছে, যার মাধ্যমে শেল্টার স্টেশন আলোকিত করার পাশাপাশি সৌরপাম্প ব্যবহার করে পানি উত্তোলন করা সম্ভব।
- বিষয় :
- ভাসানচর
- রোহিঙ্গা
- ভাসানচরে রোহিঙ্গারা