ইমোতে প্রেম ও প্রতারণা
সব আয়োজনই ছিল কনের বাড়িতে, কিন্তু এলো না বর

প্রতারক সোহাগ
শরীয়তপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২১ | ১০:৩৯
কনের দরিদ্র বাবা আয়োজনের কোনো কমতি রাখেননি। সাজানো হয়েছে বিয়ের গেট ও প্যান্ডেল। ৩০০ মানুষের খাবার রান্না হয়েছে। অতিথিরা কেউ কেউ এসে খেয়েও গেছেন। কিন্তু যাদের জন্য এই আয়োজন, সেই বরযাত্রীর দেখা নেই। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা- বারবার বরের মোবাইল ফোনে ফোন দিলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। আস্তে আস্তে বাড়ির সবাই বুঝে যান তারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। বধূবেশে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হলো না বাণীর। গত রোববার মর্মস্পর্শী ঘটনাটি ঘটেছে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বিলাসপুর ইউনিয়নের পাচুখারকান্দি গ্রামে।
বুধবার ওই গ্রামে গিয়ে জানা গেছে, দরিদ্র ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী মালেক চৌকিদারের মেয়ে বাণী ওরফে সাথীর সঙ্গে মোবাইল অ্যাপস ইমোর মাধ্যমে বছর খানেক আগে সোহাগ নামে এক যুবকের পরিচয় হয়। এরপর ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নিজেকে পুলিশ সদস্য পরিচয় দিয়ে ওই যুবক মেয়েটিকে জানান তিনি রাজশাহী শহরের বাসিন্দা। শরীয়তপুরের নড়িয়া থানায় কর্মরত। বাবা বেঁচে নেই।
এক পর্যায়ে ওই যুবক বাণীকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে মেয়েটি তার পরিবারকে জানান। বাণীর পরিবার ওই যুবক ও তার চাচা পরিচয়ে এক ব্যক্তির সঙ্গে মোবাইল ফোনে আলাপ-আলোচনার পর বিয়েতে মত দেয়। বিয়ের দিন ধার্য হয় ৩ জানুয়ারি; বরযাত্রায় লোক ৪০ জন। এরই মধ্যে ওই যুবক বাণীকে জানান, তার নাকি আইডি কার্ড হারিয়ে গেছে। বেতনের টাকা তুলতে পারছেন না। তাই বিয়ের খরচের জন্য এক লাখ টাকা দরকার। টাকা না পেলে বিয়ে করা সম্ভব হবে না। দরিদ্র মালেক চৌকিদার মেয়ের বিয়ের জন্য তার দুই কড়া জমি বিক্রি করেন। নানাজনের কাছ থেকে ঋণ নেন আরও এক লাখ টাকা। বিয়ের এক সপ্তাহ আগে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ওই যুবককে ৭০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। বাকি টাকা দিয়ে বিয়ের সব আয়োজন সম্পন্ন করেন।
বিয়ের আগের রাত পর্যন্ত বাণী ও তার পরিবারের সঙ্গে ওই যুবকের ফোনে যোগাযোগ ছিল। বিয়ের দিন সকাল থেকে বাড়িতে বিয়ের আয়োজন চলতে থাকে এবং মেহমানরাও আসতে থাকেন। বরযাত্রী কতদূর, তা জানার জন্য বাণীর পরিবার ওই যুবকের মোবাইলে বারবার ফোন দেন, কিন্তু সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। তখন সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েন। লোকজনের মধ্যে সন্দেহ বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে বিয়ে বাড়ির আনন্দ পরিণত হয় বিষাদে।
বুধবার বিকেলে বাণীদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বাণী তাদের বসতঘরের বারান্দায় নির্বাক বসে আছেন। হাতে মেহেদির রং। ঘটনার পর থেকে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। লজ্জায় কারও কাছে মুখ দেখাতে পারছেন না। নিজেকে একদম গুটিয়ে রেখেছেন। কনের মা পারুল বেগম বিলাপ করছে আর বলছেন, 'আমাদের কী সর্বনাশ হয়ে গেল। এখন আমার মেয়ের কী হবে। সমাজে আমরা মুখ দেখাব ক্যামনে।'
সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে এই প্রতিবেদককে বাণী তার মোবাইলে ওই যুবকের একটি ছবি দেখান। ছবিতে দেখা যায়, কোনো এক কোম্পানির সিকিউরিটি গার্ডের ইউনিফর্ম পরে আছেন ওই যুবক। ইউনিফর্মে লেখা সোহাগ। সিকিউরিটি। বোঝা গেল প্রাথমিক বিদ্যালয় না পেরুনো বাণী নিরাপত্তারক্ষী ও পুলিশের পোশাকের পার্থক্য বোঝেননি।
বাণীর বাবা মালেক চৌকিদার বলেন, 'আমি গরিব মানুষ। লেখাপড়া জানি না। সহায়সম্পত্তি তেমন কিছুই নেই। চার ছেলেমেয়ের মধ্যে বাণী সবার বড়। দুই কড়া জমি ছিল, তাও মেয়ের বিয়ের জন্য বিক্রি করে দিয়েছি।'
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু তাহের সরদার বলেন, 'বিষয়টি এখনও পর্যন্ত আমাকে কেউ জানায়নি। তাছাড়া ছেলে আমার ইউনিয়নের কেউ না। তার ঠিকানাও জানা নেই। এখানে আমার কিছু করারও নেই। তবে ঘটনাটি দুঃখজনক।'
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশ্রাফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, 'বিয়ের কাবিন বা লিখিত কোনো চুক্তিপত্র না হওয়া পর্যন্ত এখানে আইনগতভাবে কিছুই করার নেই। সামাজিকভাবে বিষয়টি মীমাংসা করতে হবে।'