ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

ওয়াহেদ সরদার

গাছের জন্য ভালোবাসা

গাছের জন্য ভালোবাসা

গাছ থেকে লোহার পেরেক ওঠাচ্ছেন ওয়াহেদ সরদার- সমকাল

সৌমিত্র শীল চন্দন, রাজবাড়ী

প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২১ | ২১:১৪

দুই হাতে তার ফোস্কা পড়েছে। পায়ে আঘাতের চিহ্ন। তবুও ক্লান্তি নেই তার। প্রচণ্ড শীতে বাইসাইকেল নিয়ে চষে বেড়াচ্ছেন দেশের বিভিন্ন জেলা। হাটে-মাঠে-বাজারে, যেখানে-সেখানে রাত কাটাচ্ছেন বৃক্ষপ্রেমী আবদুল ওয়াহেদ সরদার। গাছেরও প্রাণ আছে। গাছও ব্যথা পায়- এ উপলব্ধি থেকে তিনি গাছের শরীর থেকে পেরেক, কাঁটাতার তুলে ফেলছেন। ৬০ বছর বয়সী ওয়াহেদ সরদার যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া ইউনিয়নের রুদ্রপুর গ্রামের মৃত গোলাম ইয়াহিয়ার ছেলে। পেশায় ছিলেন রাজমিস্ত্রি। দু'বছর ধরে রাজমিস্ত্রির পেশা ছেড়ে গাছের প্রাণ রক্ষাকেই নিয়েছেন ধ্যানজ্ঞান হিসেবে। এ পর্যন্ত সাতটি জেলার ১৩০০ কিলোমিটার এলাকার ২৪ হাজার গাছ থেকে ১০ মণ ৩২ কেজি পেরেক, লোহা, কাঁটাতার অপসারণ করেছেন বলে দাবি তার। নিজ উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ করে পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কারও।

গত ২৮ ডিসেম্বর রাজবাড়ী শহরের শহীদ খুশী রেলওয়ে ময়দানের কাছে বিভিন্ন গাছে লোহা, পেরেক দিয়ে আটকানো ব্যানার খুলছিলেন ওয়াহেদ সরদার। সেখানেই দাঁড় করানো ছিল একটি বাইসাইকেল। বাইসাইকেলের সামনে একটি সাইনবোর্ড। যেটিতে তার ঠিকানার সঙ্গে 'গাছ বাঁচলে আমরা সবাই বাঁচবো' স্লোগানে লেখা রয়েছে গাছের শরীরে তারকাঁটা, নাইলন দড়ি চরম ক্ষতিকারক। গাছ প্রকৃতির বন্ধু। গাছে তারকাঁটা ঠোকানো অপরাধ। গাছ বাঁচাতে পেরেক, তারকাঁটা অপসারণে বৃক্ষপ্রেমিক ওয়াহেদ মাঠে নেমেছেন।
সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ার সিটে রয়েছে তার বেডিংপত্র। রডের সঙ্গে রয়েছে শাবল, মোটা পাইপ। যেগুলো দিয়ে তিনি পেরেক তোলেন। রয়েছে একটি হেলমেটও।

এ সময় আবদুল ওয়াহেদ সরদার জানান, ছোটবেলা থেকেই তিনি গাছ ও প্রাণীদের ভালোবাসেন। ২০০৬ সাল থেকে রাস্তার পাশে অথবা ফাঁকা জায়গায় তিনি ফলদ গাছের চারা রোপণ শুরু করেন। বৃক্ষরোপণের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৭ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৮ সালের ২৩ মে রাতে বাড়ির কাছে একটি গাছের নিচে বসেছিলেন। তখন মশা কামড়ানোয় তিনি গাছের সঙ্গে পিঠ চুলকান। গাছের সঙ্গে লেগে থাকা পেরেকে তার পিঠ কেটে যায়। তখনই তিনি গাছ থেকে পেরেকটি তুলে ফেলেন। দেখেন, পেরেকের ভেতরের অংশটুকু কালো হয়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে তিনি যশোরের তৎকালীন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করেন। এ বিষয়ে বিশদ বলার পর জেলা প্রশাসক একটি তালিকা তৈরি করতে বলেন। বন বিভাগকে সঙ্গে নিয়ে গাছ থেকে পেরেক অপসারণের আশ্বাস দেন তিনি। এরপর ১৮ কিলোমিটার এলাকার একটি তালিকা তৈরি করে জেলা প্রশাসকের কাছে জমা দেন। কিন্তু তারপর আর কিছু হয়নি। পরে নিজেই গাছ থেকে পেরেক তোলার কাজে নেমে পড়েন। প্রথম দিন একটি শাবল নিয়ে যশোর ডিসি অফিসের গাছ থেকে যান পেরেক তুলতে। অনেকগুলোই তোলেন। ওইদিন তিনি স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে এক হাজার টাকা নিয়ে পাইপ ও শাবল কেনেন।

এসব নিয়ে যশোর থেকে ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, খুলনা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ঘুরে রাজবাড়ী জেলায় আসেন গত ২৪ ডিসেম্বর। এসেই একটি গাছ থেকে ২২৬টি লোহা তুলেছেন।
তিনি বলেন, বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র আবিষ্কার করেছেন গাছের প্রাণ আছে। যার প্রাণ আছে তার অনুভূতি শক্তিও আছে। গাছের শরীরে পেরেক মারলে গাছ ব্যথা পায়- এটা আমি উপলব্ধি করি। মানুষের বৈরী আচরণের কারণে শত শত গাছ মারা যাচ্ছে। সবাই যদি এটা উপলব্ধি করতে পারত, তাহলে বোবা প্রাণীটা কষ্ট পেত না। গাছের পেরেক তুলতে গিয়ে অনেক সময় আহত হতে হয় তাকে। পেরেক মাথায় পড়ে, একবার পা কেটে যায় তার।

তিনি বলেন, গাছের পেরেক তুলতে গিয়ে আমার তিনটি কাজ হচ্ছে। এক, শরীরের ব্যায়াম। দুই, দেশ ভ্রমণ। তিন, গাছগুলো রক্ষা পাচ্ছে।

দুই ছেলে এক মেয়ের বাবা আবদুল ওয়াহেদ। সংসার নিয়ে তার কোনো চিন্তা নেই। অর্থাভাবে নিজে পড়াশোনা করতে না পারলেও ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করেছেন। জানালেন, এ কাজে বাড়ি থেকে কেউ বাধা দেয় না। তিনি বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। তাকে আমার কাজের কথা জানাতে চাই।

আরও পড়ুন

×