ঈশ্বরদীর দুই আদিবাসী পল্লি যেন ছিটমহল

সেলিম সরদার, ঈশ্বরদী (পাবনা)
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯ | ১৫:০৪ | আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯ | ১৫:৩০
বাংলাদেশের ভূখণ্ডে তাদের বাস এবং তারা এ দেশেরই নাগরিক। তার পরও শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ সব ধরনের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার মাড়মী এবং বেতবাড়িয়া-পতিরাজপুর গ্রামের আদিবাসী পল্লি যেন এক টুকরো ছিটমহল। পল্লির অধিবাসীদের জন্য নেই স্থানীয়ভাবে চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা। অসুখ-বিসুখ হলে তাদের যেতে হয় উপজেলা সদর হাসপাতালে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে তাদের নূ্যনতম ধারণাও নেই। বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ সরকার প্রদত্ত কোনো ভাতাই তারা পান না। খ্রিষ্টান মিশন পরিচালিত একমাত্র স্কুলটিও বন্ধ। পল্লির কিছু শিশু অনেক কষ্ট করে দূরের স্কুলে গেলেও অধিকাংশ শিশুই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। বঞ্চনার এখানেই শেষ নয়। বহু বছর আগে জঙ্গল কেটে বিশাল একটি পুকুর খনন করেন এ পল্লির বাসিন্দারা। এখন সেটিও তারা ব্যবহার করতে পারছেন না।
সরেজমিন উপজেলা সদর থেকে ৮-১০ কিলোমিটার দূরে মাড়মী আদিবাসী পল্লিতে গিয়ে দেখা যায়, ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত সেন্ট ফিলিপস শিশু শিক্ষাকেন্দ্রটি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। শিশুদের কলকাকলি বা কোনো প্রাণচাঞ্চল্য নেই। পল্লির বাসিন্দারা জানান, স্কুলটিতে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী ছিল। শুরুতে খ্রিষ্টান মিশন পরিচালনা করা হলেও পরে কারিতাস নামে একটি বেসরকারি সংস্থা এর দায়িত্ব নেয়। কিন্তু অর্থাভাবে তারাও এক বছর হলো শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। এখন পল্লির শিশুরা আর স্কুলে যায় না, তারা বাবা-মায়ের সঙ্গে মাঠে কাজ করে। কিছু ছেলেমেয়ে হেঁটে দু-তিন কিলোমিটার দূরের একটি স্কুলে গেলেও তাদের কষ্টের শেষ নেই।
মাড়মী আদিবাসী পল্লির প্রবীণ বাসিন্দা পৌল বিশ্বাস জানান, প্রায় দুইশ' বছর আগে নীলচাষ করতে ও এ এলাকার রাজা-প্রজাদের বন্য হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে এখানে আমাদের পূর্বপুরুষদের এনে বসবাস শুরু করানো হয়। সে সময় এখানে ঘন বন ও বড় বড় গাছ কেটে একটি বিশাল দীঘি খনন করেন আদিবাসীরা। জঙ্গলের কাঠ কেটে, দীঘিতে মাছ ও পশু শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা। কিন্তু ২০ বছর ধরে এ দীঘিতে মাছের চাষ করেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। নিয়ম অনুযায়ী একটি সমিতির মাধ্যমে সবাইকে নিয়ে এ দীঘি পরিচালনা করার কথা থাকলেও আদিবাসীদের রাখা হয় না কমিটিতে। দীঘিতে মাছ চাষের ২০ শতাংশ লভ্যাংশ আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ থাকলেও সেটাও মানা হচ্ছে না। দাশুড়িয়া ইউনিয়নের সাবেক ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আফসার আলী জানান, প্রায় ৩৩ বিঘা আয়তনের দীঘিটি ১৯৯৫ সালে পাবনার জসেদ চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি নিজের দাবি করে আদালতে মামলা করেন। পরে তিনি এটি নিজের কব্জায় নিয়ে ভোগদখল করলেও ২০০০ সালে দীঘিটি কালীমন্দিরের সম্পত্তি বলে আদালত রায় দেন।
মন্দির কমিটির সভাপতি সুবল রায় জানান, দীঘিটি পাঁচজন মুসলমান, পাঁচজন হিন্দু, পাঁচজন আদিবাসীসহ ১৫ জনের একটি সমিতি দিয়ে পরিচালিত হওয়ার নিয়ম চালু করেছেন তারা। তবে ডমিনিক বিশ্বাস বলেন, এ কমিটিতে কোনো আদিবাসীর নাম নেই। এসব বিষয়ে পাবনার জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ বলেন, দীঘিটি আদিবাসীদেরই তৈরি করা। এটি তাদেরই ব্যবহার করার কথা। কেন তাদের সেখানে রাখা হয়নি সে বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পল্লির ডমিনিক বিশ্বাস মাস্টার আরও জানান, মাড়মী আদিবাসী পল্লির বাসিন্দাদের বেশিরভাগই মাল পাহাড়ি সম্প্রদায়। সারাবছর কৃষি শ্রমের পাশাপাশি দীঘি ও জঙ্গলে শিকার করেই এদের জীবন-জীবিকা চলে। কিন্তু বছরের বেশির ভাগ সময় কাজ না না থাকায় বেকার থাকতে হয় তাদের। মাছ বা পশু শিকারের জায়গা নেই, দীঘিও এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। আবার সরকারের দেওয়া বিভিন্ন ভাতা থেকেও বঞ্চিত তারা। ফলে নিদারুণ কষ্টে চলছে তাদের জীবন।
অশীতিপর ক্লেমেন্ট বিশ্বাস বলেন, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছে এ পর্যন্ত পাঁচবার কাগজ জমা দিয়েছি, আজও বয়স্ক ভাতার একটি কার্ড পাইনি। গৃহবধূ রিতা বিশ্বাস বলেন, আমরা এ পল্লির নারীরা বিধবা ভাতার আবেদন করেও পাই না। অষ্টম শ্রেণির প্রতিবন্ধী মেধাবী শিক্ষার্থী লিজা বিশ্বাস বলে, আমি অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছি; কিন্তু একাধিকবার আবেদন করেও প্রতিবন্ধী ভাতার একটি কার্ড পাইনি। মাইকেল বিশ্বাস, যোশেফ বিশ্বাস, মনিকা, সুব্রত বিশ্বাসসহ বেশ কয়েক শিক্ষার্থী জানায়, সেন্ট ফিলিপস শিশু শিক্ষাকেন্দ্রটি বন্ধ হওয়ার পর থেকে তাদের লেখাপড়া এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে জোবেদা খাতুন সাবান আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরতি বিশ্বাস, অমৃতা বিশ্বাস, নৌমি, অণিক বিশ্বাসসহ অন্যান্য শিক্ষার্থী জানায়, দূরের স্কুল ও মাঠ পেরিয়ে কাদা-ধুলা মাড়িয়ে যাতায়াত করতে গিয়ে বছরের বেশির ভাগ সময়েই তারা স্কুুলে অনুপস্থিত থাকে। জোবেদা খাতুন সাবান আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সাইদুর রহমান জানান, মাড়মী আদীবাসী পল্লির স্কুল বন্ধের পর ২৬ জন শিক্ষার্থী এ স্কুলে ভর্তি হয়েছে। আশপাশের আরও দু-তিনটি স্কুলে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও ওই গ্রামের অনেক শিক্ষার্থীর পড়ালেখা বন্ধ রয়েছে। তারা কোনো স্কুলেই ভর্তি হয়নি।
এদিকে, উপজেলার মুলাডুলি ইউনিয়নের বেতবাড়িয়া, পতিরাজপুর গ্রামের আদিবাসী পল্লিতে ৭০ পরিবারের চার শতাধিক আদিবাসীর বাস। এই পল্লিতেও কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। এখানকার শতাধিক শিক্ষার্থী নানা প্রতিবন্ধকতা মেনে নিয়ে আশপাশের স্কুল-কলেজে পড়ালেখা করছে। এই পল্লির নারী-পুরুষ সবাই কৃষি কাজের ওপর নির্ভরশীল। অশীতিপর ভবেশ চন্দ্র রায় বলেন, দুইশ' বছর আগে বর্ধমান থেকে এখানে নীল চাষ করতে তাদের পূর্বপুরুষরা আসেন। তখন থেকেই তাদের ঈশ্বরদীর এ পল্লিতে বসবাস। কৃষি শ্রমিক সারথি রানী রায় বলেন, বছরের অর্ধেক সময় তাদের কাজ থাকে না। আবার কাজের মজুরিতেও আমাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। এখনও তিনশ' টাকা মজুরিতে কাজ করতে হয় আমাদের।
সত্য সরদার রায় ও সন্তোষ রায় বলেন, লেখাপড়ার ভালো ব্যবস্থা না থাকায় প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোনোর পর পল্লির ছেলেমেয়েদের আর পড়ালেখা করা হয় না। প্রবীণ বাসিন্দা সাধন রায় বলেন, আমরা কেউ বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতাসহ সরকারের সব ধরনের ভাতা থেকে বঞ্চিত। গৃহবধূ মৌসুমি রায় বলেন, আমাদের স্বাস্থ্যসেবার কোনো ব্যবস্থা নেই। সামান্য অসুখ হলেও আট কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে যেতে হয় চিকিৎসা নিতে।
দাশুড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বকুল সরদার বলেন, আদিবাসী পল্লির দুই কিলোমিটার রাস্তা পাকাকরণের প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এ ছাড়া অন্যান্য সুবিধা সরকার দিলেও আইনি জটিলতায় আদিবাসীদের বয়স্কভাতার কার্ড দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে খোঁজ নিয়ে সে ব্যবস্থা করা হবে।
ঈশ্বরদী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মৃণাল কান্তি সরকার বলেন, আদিবাসী পল্লির স্কুলটি এক বছর আগে বন্ধ হয়েছে কি-না, আমার জানা নেই। এ পল্লির শিক্ষার্থীরা চাইলে নিকটবর্তী যে কোনো স্কুলে ভর্তি হতে পারে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিহাব রায়হান বলেন, আমি ঈশ্বরদীতে নতুন এসেছি। দুই আদিবাসী পল্লির স্কুলসহ অন্যান্য বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখব। প্রাপ্য অনুযায়ী সরকারি সুযোগ-সুবিধা সেখানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হবে।
- বিষয় :
- ঈশ্বরদী
- পাবনা
- আদিবাসী পল্লি
- ছিটমহল