ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ছোট হয়ে আসছে হাতির পৃথিবী!

ছোট হয়ে আসছে হাতির পৃথিবী!

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর চাম্বল এলাকায় মরে পড়ে থাকা বন্য হাতি- সমকাল

সারোয়ার সুমন ও জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২১ | ১৭:০৪

হাতির মাথার ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে ভয়ানক বিপদ। মৃত্যুফাঁদে ক্রমে ছোট হয়ে আসছে তার চারণভূমি। বেঘোরে প্রাণও যাচ্ছে মানুষের লোভ, হিংসা আর অজ্ঞতার শিকার হয়ে। গত আট দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ছয়টি হাতির মরদেহ মিলেছে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও বাঁশখালী, শেরপুরের শ্রীবরদী, কক্সবাজারের চকরিয়ার পূর্ণগ্রাম ও হারবাংয়ে এসব হাতি মারা গেছে গুলিতে অথবা বিদ্যুতের তৈরি ফাঁদে পা দিয়ে।

সর্বশেষ গতকাল শনিবার হারবাংয়ে হত্যার পর মাটিচাপা দেওয়া একটি হাতির মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। আনুমানিক পাঁচ দিন আগে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে হাতিটি হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয় বলে জানান ময়নাতদন্তের দায়িত্বে নিয়োজিত চকরিয়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ভেটেরিনারি সার্জন) ডা. সুপন নন্দী। পচে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকলে হাতির মৃত্যুর বিষয়টি টের পাওয়া যায়।

বিপন্ন প্রাণীদের তালিকায় থাকা এশীয় হাতির এভাবে একের পর এক মৃত্যুতে উদ্বেগ জানিয়েছেন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা। এ নিয়ে চট্টগ্রাম, শেরপুর, সিলেটসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। নির্বিচারে বন্য হাতি হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে তারা বলেছে, হাতি রক্ষায় প্রশাসনের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ছয়টি হাতির মৃত্যুতে এখন পর্যন্ত মামলা হয়েছে দুটি। গ্রেপ্তার হয়েছে মাত্র একজন। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হলে বাংলাদেশ থেকে এশীয় হাতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা পরিবেশবাদীদের।

এত হাতির মৃত্যুর কারণ: বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে হাতির বিচরণের পথ দ্রুত কমে আসছে। গত ছয় বছরে বন্ধ হয়ে গেছে হাতি চলাচলের তিনটি করিডোর। বাধ্য হয়ে বিশালাকার এ প্রাণীটি মানুষের বসতি এলাকা দিয়েই চলাচলের চেষ্টা করছে। আর মানুষ আতঙ্কিত হয়ে হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করছে।

এদিকে, কক্সবাজারের যেখানটায় রোহিঙ্গারা বসতি করেছে, তার পুরোটাই ছিল হাতির বিচরণক্ষেত্র। সেই আবাস এখন ধ্বংস হয়ে গেছে। অন্যদিকে, শেরপুরের বনাঞ্চলে অনেক হাতি ভারতের মেঘালয় থেকে খাবারের সন্ধানে বাংলাদেশের দিকে চলে আসে, বিশেষ করে বর্ষার পরে যখন নতুন ঘাস জন্মায় এবং পাকা ধানের মৌসুমে। অনেক হাতিই এখানে থেকে যাচ্ছে, বাচ্চা প্রসব করছে। কিন্তু গত এক দশকে বন বিভাগের বহু জমি মানুষের দখলে চলে যাওয়ায় হাতির এই বিচরণক্ষেত্র হাতির জন্য আর নিরাপদ নেই।

গুলি করে ও বিদ্যুতের তারের মাধ্যমে তৈরি ফাঁদ দিয়ে বাংলাদেশে একের পর এক হাতি হত্যা করা হচ্ছে। কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে ২০১৯ ও ২০২০ সালে অন্তত চারটি হাতির মরদেহ পাওয়া গেছে গুলিবিদ্ধ অবস্থায়। গত মঙ্গলবার চকরিয়ার পূর্ণগ্রামে গুলি করে হত্যা করা হয় একটি হাতিকে। এ ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও অতীতের ঘটনায় ধরা পড়েনি কেউ। রাঙামাটি ও বান্দরবান সীমান্তে পাওয়া গেছে গুলিবিদ্ধ একাধিক হাতি। কারা এসব হাতিকে গুলি করেছে, তা এখনও জানা যায়নি।

প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন এবং বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৭ বছরে ৯০টি হাতি হত্যার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২০২০ সালেই ১১টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। সব ঘটনাই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এলাকার। সেগুলোর মধ্যে সাতটি মারা যায় বিদ্যুৎস্পর্শে। বাকিগুলো মরেছে গুলি খেয়ে। গত শতাব্দীর শেষদিকেও দেশে হাতি ছিল ৫০০টি। ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, হাতির সংখ্যা ২৬৩। দেশের মোট হাতির ৫৫ শতাংশই থাকে কক্সবাজার অঞ্চলে।

বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে হাতি হত্যার মামলা জামিনের অযোগ্য। অপরাধীকে সর্বনিম্ন দুই বছর ও সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদ এবং সর্বনিম্ন এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদ দেওয়ার বিধান রয়েছে। একই অপরাধ পুনরায় করলে সাজা সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদ এবং সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা। বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ছয় বছরে হাতি হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৪টি। তবে একটিরও নিষ্পত্তি হয়নি। কেউ সাজা পেয়েছে- এমন নজির নেই।

হাতির বিচরণ নিয়ে ২০১৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) গবেষণায় বলা হয়, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে হাতির আবাসভূমি ও চলাচলের পথগুলো নিয়মিতভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে। সেখানে গাছপালা কেটে ফসলের চাষ হচ্ছে। বনের বাইরেও ধানের চাষ বাড়ছে। খাদ্য সংকটে অভুক্ত হাতি আমন ধান পাকলে তা খেতে বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। এ সময় কিছু মানুষ বিদ্যুতের তারের ফাঁদ পেতে অথবা গুলি করে হাতি মেরে ফেলছে।

১৯৭৫ সাল থেকে ভারত হাতির ওপর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, বাঘের ডাক রেকর্ড করে বাজানো, বাঘের মূত্র ফসলি জমিতে ছিটানো ও মরিচের গুঁড়া ছুড়ে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা করছে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বন বিভাগ ও আইইউসিএন বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে 'স্ট্রেংদেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ওয়াইল্ডলাইফ প্রটেকশন' প্রকল্পের আওতায় স্ট্যাটাস সার্ভে অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অব এলিফ্যান্ট অ্যাকশন প্ল্যান ফর বাংলাদেশ উপপ্রকল্পের মাধ্যমে ২০১৬ সালে মানুষ-হাতি সংঘাত নিরসনে ধারণা দেওয়ার জন্য একটি মাঠ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা সহায়িকা প্রকাশ করা হয়। সহায়িকাতে বেশ কিছু পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়। এতে জমির পাশে কাঁটাযুক্ত গাছ লাগানো, হাতির অপছন্দের শস্য চাষ, গাছে ঘণ্টা বা অ্যালার্ম লাগানো, হাতির পছন্দের খাবার মজুদ না করাসহ নানা পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু এসব পরামর্শ কাগজে থাকলেও মাঠে প্রয়োগ নেই। নেই সচেতনতামূলক কার্যক্রম।

আকিজ ওয়াইল্ডলাইফ ফার্ম লিমিটেডের ইনচার্জ ও এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের প্রশিক্ষক আদনান আজাদ বলেন, সাধারণ মানুষ জানেই না- হাতি মারা অপরাধ। বন বিভাগ শুধু ঢাকায় সভা-সেমিনার করে; যদিও সচেতনতা প্রান্তিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার।

শেরপুরের যে জায়গায় হাতি মারা গেছে, সেখানে ব্যক্তিগত গবেষণার জন্য গিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও এশিয়ান এলিফ্যান্ট স্পেশালিস্ট গ্রুপের সদস্য মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ। তিনি বলেন, একের পর এক হাতি মারা গেলেও সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার তৎপরতা নেই। এভাবে চলতে থাকলে হাতি রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে।

হাতি লোকালয়ে প্রবেশ করায় হত্যার ঘটনা ঘটছে বলে অনেকে মত দিলেও এর বিরোধিতা করে তিনি বলেন, হাতি লোকালয়ে আসছে না বরং হাতির আবাসভূমিই দখল করছে মানুষ। আইইউসিএন হাতির বিচরণক্ষেত্র চিহ্নিত করে দিলেও গত এক দশকে মানুষ এসব স্থানে বসতি গড়েছে। বন বিভাগের জমি ইজারা নিয়ে চাষবাষ করছে। হাতি তার বিচরণক্ষেত্রে কিছু পেলেই ল ভ করে দেয়। সেখান থেকেই হাতি আর মানুষের দ্বন্দ্ব বাড়ছে।

আইইউসিএন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাকিবুল আমিন বলেন, কৃষকের কাছে গুলি থাকার কথা নয়। তাহলে হাতির ওপর গুলি করছে কারা? ফসলের জমিতে বিদ্যুতের তার লাগানো সহজ কাজ নয়। তাহলে কোথা থেকে, কারা এটির সংযোগ দিচ্ছে? বন বিভাগের দায়িত্বশীলরা এসব দেখছেন না কেন? পুলিশ প্রশাসন কেন খতিয়ে দেখছে না বন্দুকের উৎস? এই নির্মমতা বন্ধ না হলে হাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

হাতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এ এইচ এম রায়হান সরকার। তিনি বলেন, হাতির প্রতি মানুষ এতটা নির্মম হচ্ছে কেন- তা খতিয়ে দেখতে হবে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে নতুন করে ভাবতে হবে বন বিভাগকে।

সেভ দ্য নেচারের চেয়ারম্যান আ ন ম মোয়াজ্জেম হোসেন বন্য হাতি হত্যা বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া ও হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি নিশ্চিত করা, হাতির প্রাকৃতিক চলাচলের পথ ও খাবার পানির উৎস সংরক্ষণ, হাতির নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও প্রাণী কল্যাণ আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের দাবি জানান।

বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সার্কেলের বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিম বলেন, বন বিভাগে জনবল ও বাজেটের স্বল্পতা আছে। এ মুহূর্তে হাতি সংরক্ষণে কোনো প্রকল্প নেই। তবে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মানুষ ও হাতির সংঘাত নিরসনে একটি প্রকল্পের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়কে। তিনি বলেন, মানুষ হাতির করিডোর দখল করে সেখানে বাড়িঘর করছে। সরকারও বিভিন্ন জায়গায় ভূমি ইজারা দিচ্ছে। অনেক মামলা করেছি; কিন্তু সেগুলো এখনও ঝুলে আছে।

বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক এএসএম জহির উদ্দিন আকন বলেন, একজন কর্মকর্তাকে গড়ে দুই হাজার হেক্টরের মতো বিশাল এলাকা দেখভাল করতে হয়। তার পক্ষে এককভাবে সব মনিটর করা অসম্ভব ব্যাপার।

ক্ষতিপূরণ পেতে কৃষকের ভোগান্তি: হাতি যাদের ফসল নষ্ট করছে, তাদের ক্ষতিপূরণ বাবদ সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষতিপূরণ পেতে পদে পদে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। চলতি বছর চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৫ জন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আবেদন করলেও বেশিরভাগই টাকা পাননি। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ) রফিকুল ইসলাম চৌধুরী বলছেন, অনেকে নিয়ম মেনে আবেদন করছেন না। এতে ক্ষতিপূরণ দিতে সময় লাগছে।

আরও পড়ুন

×