অর্থনীতি
আইএমএফের শর্ত মেনে বাজারভিত্তিক ডলার

ছবি: সংগৃহীত
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৫ | ০৭:৩৪ | আপডেট: ১৫ মে ২০২৫ | ১১:৫৫
আইএমএফের ঋণের দুটি কিস্তির অর্থছাড় নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিন টানাপোড়েনের পর অবশেষে সমঝোতায় পৌঁছেছে দুই পক্ষ। আইএমএফের শর্ত মেনে টাকার সঙ্গে ডলার এবং অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতদিন বাংলাদেশ ব্যাংক একটা সীমার মধ্যে দর ওঠানামা করতে দিত। নতুন সিদ্ধান্তের কারণে সেই সীমা থাকলো না।
আইএমএফের সমঝোতার কারণে বিশ্বব্যাংক, জাইকাসহ কয়েকটি সংস্থার ২২০ কোটি ডলার জুনের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে। সব মিলিয়ে ৩৫০ কোটি ডলার পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। গতকাল দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এসব তথ্য জানান। সংবাদ সম্মেলনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
পরে সন্ধ্যায় ওয়াশিংটন থেকে আইএমএফ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের কর্মকর্তা পর্যায়ের সমঝোতা হয়েছে। আইএমএফের পর্ষদ অনুমোদন দিলে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ১৩০ কোটি ডলার ছাড় হবে। এদিকে, বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণার দিন গতকাল প্রতি ডলারের দর ১২২ থেকে বেড়ে ১২৩ টাকা হয়েছে।
গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দুবাই থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে ডলারের দর বাজারভিত্তিক করার ঘোষণা দেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তিন ডেপুটি গভর্নরসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। গভর্নর বলেন, সব ব্যাংকের সহায়তায় বাজার স্থিতিশীল থাকবে বলে তিনি আশা করেন। দুবাইয়ের কিছু এক্সচেঞ্জ কোম্পানি হয়তো বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করবে। এ ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে। তবে বাংলাদেশের এখন যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার শক্তি আছে। ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে তারা আত্মবিশ্বাসী। বাজারে হস্তক্ষেপের জন্য ৫০ কোটি ডলারের একটি তহবিল করা হয়েছে।
গভর্নর বলেন, গত আট মাসে সামগ্রিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা এসেছে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স ভালো অবস্থায় আছে। বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন ভারসাম্যে উন্নতি হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি কমেছে, আগামীতে আরও কমবে। গত আট মাসে বিনিময় হারে কোনো অস্থিরতা নেই। কোনো কৃত্রিমতা ছাড়াই বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে। আত্মবিশ্বাসের জায়গা তৈরি হয়েছে। যে কারণে ডলার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আগামীতেও হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হবে না। তবে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ব্যবস্থা চালুর মানে এই নয়, যে কোনো দরে কেনা যাবে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, চালের দর যদি ৬০ টাকা হয় ক্রেতা ৬০, ৫৯ বা ৬১ টাকায় কিনবে। কিন্তু কেউ যদি ৭০ থেকে ৮০ টাকায় কেনে, তাহলে সেখানে কারসাজি আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এভাবেই বিষয়টি দেখবে। বড় পরিশোধের দরকার হলে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক থেকে কিনবে। প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে ডলার দেবে।
তিনি বলেন, ডলার স্থিতিশীল রাখতে হলে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে স্থিতিশীলতা রাখতে হবে। রপ্তানি-রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি রাখতে হবে। আমদানি বাড়বে, তবে সংযতভাবে। সবকিছুর মধ্যে ভারসাম্য রাখতে পারলে বিনিময় হারও ভারসাম্যহীন হবে না। বিনিময় হার স্থিতিশীল করতে পারলে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। বিনিময় হার স্থিতিশীল করার একটি উপাদান সুদহার। এখন সুদহার বেশি থাকায় টাকার মূল্যমান ধরে রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। তিনি মনে করেন, অযৌক্তিকভাবে কোনো দরে ব্যাংকগুলোর ডলার কেনার দরকার হবে না। বাজারে যথেষ্ট সরবরাহ আছে। কোনো ব্যাংক অযৌক্তিক কিছু করছে কিনা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা তদারকি করবে।
গভর্নরের ঘোষণার কিছুক্ষণ পর একটি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সার্কুলারে গত ৩১ ডিসেম্বর বিনিময় হার-সংক্রান্ত জারি করা নির্দেশনা অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, ব্যাংকগুলো নিজেদের মতো করে ডলার বেচাকেনার দর নির্ধারণ করবে। বাজারে লেনদেনের ভিত্তিতে প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে একটি রেফারেন্স বেঞ্চমার্ক দর ঘোষণা করা হবে। আর তদারকির লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রতিদিন দুইবার ডলার বেচাকেনার তথ্য দিতে হবে।
জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু সমকালকে বলেন, ডলারের দর বাজারভিত্তিক করার আলোচনা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ গভর্নর থাকার সময় থেকে হয়ে আসছে। এখন এটি করার কারণে ডলার সংকট দেখা দিলে হয়তো দর বাড়বে। তবে ২০২৩ সালে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েই আইএমএফের ঋণ নেওয়া হয়েছে। ফলে এখন এটি নিয়ে কিছু করার নেই। আগের সরকার দীর্ঘদিনডলারের দর ৮৪ টাকায় ধরে রেখেছিল। সেই নীতি ভালো কিছু ছিল না।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, ডলারের দর নির্ধারণে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এটি ভালো সিদ্ধান্ত। কেননা হস্তক্ষেপ থাকলে লুকোচুরির সুযোগ তৈরি হয়।
তিনি বলেন, ডলার বাজারভিত্তিক করার ক্ষেত্রে গত বছরের ডিসেম্বরে দেওয়া নীতিমালা অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি লেনদেনে প্রতিদিন দুইবার তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথ্য নেবে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বুঝতে পারবে বাজারে কী অবস্থা। আবার গড় দরের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে তথ্য দেওয়া হবে। ফলে ব্যাংকও বুঝতে পারবে বাজারের কী অবস্থা। বৈশ্বিক বাজারে ডলারের দর কমায় এখন ধাক্কা আসার সম্ভাবনা কমেছে। যদি আসেও আইএমএফ কর্মসূচির কারণে এটি সহায়ক হবে। বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ অন্য সবার ঋণ ছাড় হবে।
হঠাৎ কেন সম্মত হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক
সম্প্রতি এডিবির বার্ষিক সভায় এক বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘চট করে আইএমএফের কঠিন শর্ত মেনে নিয়ে কিছুই করা হবে না। মুদ্রা বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো করতে চাই না। আইএমএফের কিস্তি ছাড়াই অর্থনীতি স্থিতিশীল হয়েছে। আমরা যদি আইএমএফ ও এডিবির সহায়তা নাও পাই, তাও নিজেদের মতো করে বাস্তবসম্মত বাজেট দেওয়া হবে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী দু’জনেই সম্প্রতি বলেছেন, প্রয়োজনে আইএমএফের ঋণ নেওয়া হবে না। সব শর্ত মানা হবে না।
এখন কেন হঠাৎ নমনীয় হলেন– এমন প্রশ্নের উত্তরে সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর বলেন, ‘আইএমএফের কিস্তি নিয়ে পত্রিকায় বড় বড় হেডলাইন হচ্ছিল। বলা হচ্ছিল, আইএমএফের ঋণ না পেলে সংস্কার নীতি থেকে সরকার সরে যাবে। আমরা সংস্কার থেকে সরে যাইনি। এ কারণে আইএমএফ সরে যায়নি। আমরা তাদের সরিয়ে রেখেছিলাম। এখন মনে করি, সমঝোতার সময় এসেছে।
তিনি বলেন, আমরা সব সময় আলোচনার মধ্যে ছিলাম। সবকিছু সম্মত হয়ে এরপর আমরা বিনিময় হার নিয়ে সম্মত হয়েছি। সব সম্পন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত এ নিয়ে কিছু বলা হয়নি।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ড. হাবিবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ শুধু সম্মত হয়েছে তেমন নয়। আইএমএফ তাদের শর্তের কিছু জায়গায় ছাড় দিয়েছে। দু’পক্ষই কিছু ছাড় দিয়ে এরপর সমঝোতায় পৌঁছানো হয়েছে।
ঋণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে জানিয়েছেন, রাজস্বসংক্রান্ত শর্তের বিষয়ে বেশ আগেই উভয় পক্ষ ঐকমত্যে পৌঁছেছে। সর্বশেষ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে দুটি বিভাগ করা হয়েছে মূলত সংস্থাটির শর্ত মেনে। স্বার্থের সংঘাত কমাতে দীর্ঘদিন ধরে করনীতি ও কর ব্যবস্থাপনার কাজ আলাদা করার পরামর্শ দিয়ে আসছে। আগামী অর্থবছরে কর-জিডিপির শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ বাড়তি করের লক্ষ্যমাত্রার বিষয়ে উভয় পক্ষ সম্মত। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ, আর্থিক খাত সংস্কারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া পদক্ষেপ, নীতি-সহায়তা নামে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার বিভিন্ন উদ্যোগে সংস্থাটি বেশ আগেই সন্তোষ প্রকাশ করেছে।
আইএমএফের বিবৃতি
আইএমএফ গতকাল সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে শর্ত সাপেক্ষে দুই পক্ষের সমঝোতায় পৌঁছানোর কথা জানিয়েছে। সংস্থাটির বিবৃতিতে বলা হয়, আইএমএফ স্টাফ এবং বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যালোচনা শেষ করতে একমত হয়েছে। এ সমঝোতা বিনিময় হার সংস্কারের পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং কর-রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত পদক্ষেপ শেষ করা সাপেক্ষে আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডের অনুমোদনের ওপর নির্ভরশীল। ঋণের তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যালোচনা অনুমোদিত হলে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ১৩০ কোটি ডলার পাবে বাংলাদেশ।
আইএমএফের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ৭৬ কোটি ডলার বাড়তি ঋণ চেয়েছে। বাড়তি ঋণ যোগ হলে মোট দাঁড়াবে ৫৪০ কোটি ডলার। বিবৃতিতে বিনিময় হার, রাজস্ব আদায়, ব্যাংক খাতসহ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ কর্মসূচির তিন কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন শর্তের কারণে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে।
জুনের মধ্যে ৩৫০ কোটি ডলার পাওয়ার আশা
আইএমএফের সঙ্গে স্টাফ পর্যায়ের সমঝোতার পর আগামী মাসে সংস্থাটির পর্ষদ সভায় ঋণ অনুমোদন হবে বলে আশা করেন গভর্নর। তিনি বলেন, আইএমএফে ঋণ অনুমোদনের পর অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোই ঋণ ছাড় করবে। সব মিলিয়ে জুনের মধ্যে সাড়ে তিন বিলিয়ন বা ৩৫০ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণ পাওয়া যাবে। এতে করে রিজার্ভ আরও বাড়বে। বিনিময় হার টেকসই স্থিতিশীল হবে।
জানা গেছে, আইএমএফ ঋণের দুই কিস্তির ১৩০ কোটি ডলারের বাইরে পাঁচটি সংস্থা থেকে বাকি ঋণ পাওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকা দেবে ৫০ কোটি ডলার করে ১৫০ কোটি ডলার। বাকি ৭০ কোটি ডলার আসবে এআইআইবি ও ওপেক থেকে।
- বিষয় :
- আইএমএফ