ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

প্রকৃতি

যেখানে অতীত ফিরে আসে

যেখানে অতীত  ফিরে আসে

আয়ারল্যান্ডের ওয়ি দ্বীপে সুউচ্চ পাথরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে জলরাশি বিবিসি

 শিলু হোসেন

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২৫ | ০১:০৮ | আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৫ | ০৮:০৮

চাঁদের আলোয় টলমল করছে নীল স্বচ্ছ জল। পাশে সবুজ ঘাসের ওপর খেলছে একদল কুকুর। কিছু মুরগিও বিচরণ করছে অবাধে। ঘাসের ওপর পুড়তে থাকা কাঠের টুকরোর পুড় পুড় শব্দের সঙ্গে সাগরের গর্জন মিশে হাজির অন্যরকম আবহ। এমন সময়ে আশপাশে হাতেগোনা বাড়িগুলোর জানালা থেকে মৃদু আলো চোখে পড়ে। তবে সেখানে কোনো মানুষের সাড়া নেই।

এমনই আদিম নিস্তব্ধতা নিয়ে জেগে থাকে আয়ারল্যান্ডের ওয়েস্ট কাউন্টি ডোনেগালের উপকূলের ওয়ি দ্বীপের গ্রীষ্মের রাতগুলো। এ দ্বীপকে আইরিশ ভাষায় ‘ইউইগ’ বলা হয়, যার অর্থ গুহা। দ্বীপটিকে গুহা বলার কারণ, বিভিন্ন স্থানে দুই পাশে সুউচ্চ পাথরের মাঝখান দিয়ে জলরাশি বয়ে গেছে। এ দ্বীপ পশ্চিম কাউন্টি ডোনেগালের কিনসাস্লাগের কাছাকাছি ক্রুট দ্বীপের পাশে অবস্থিত। সত্তরের দশকে সেখানে প্রায় ৩০টি পরিবারের ১০০ বাসিন্দা থাকতেন। আধুনিকতার আকর্ষণে দ্বীপ ছেড়ে তারা নগরমুখী হন। এভাবে ১৯৭৭ সালের দিকে দ্বীপটি একেবারে জনশূন্য হয়ে পড়ে। এর পর প্রায় ২৫ বছর এটি পরিত্যক্ত ছিল।

নির্জন ওয়ি দ্বীপে জনবসতি গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে এক জাতিগত সংঘাতের ভূমিকা। ষাটের দশকের গোড়ায় উত্তর আয়ারল্যান্ডে সংঘটিত এ সংঘাত ‘ট্রাবলস’ নামে পরিচিত। সে সময়, অর্থাৎ ১৯৭০ সালে ট্রাবলস চলাকালে অশান্তি এড়াতে ওয়ি দ্বীপে বসবাস শুরু করেন অনেকে। তাদের মধ্যে ছিল পল কোয়ানের পরিবারও। 
তাঁর ভাষ্যমতে, সত্তর দশকের প্রথম দিকে তাদের পরিবার ওয়ি দ্বীপে আসে। কোয়ানের মা রুটল্যান্ড দ্বীপ থেকে এসেছিলেন, যা ওয়ি দ্বীপের পাশেই অবস্থিত। ট্রাবলসের কারণে সে সময় খুব বাজে পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাই তাঁর বাবা ভেবেছিলেন, ঝামেলা এড়াতে কোনো দ্বীপে বাড়ি করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এর পর তো কোয়ানের কৈশোরের পুরো সময় ওয়ি দ্বীপেই কাটে। পরে অবশ্য তিনি বেলফাস্টে ফিরে যান। দীর্ঘ সময় পর ২০০০ সালে কোয়ান ও তাঁর ভাইয়েরা সিদ্ধান্ত নেন, সন্তানদের একঘেয়েমি দূর করতে ওয়ি দ্বীপে নৌভ্রমণে যাবেন। নির্জন দ্বীপে ফিরে তারা দেখেন, ২৫ বছরেরও বেশি সময় আটলান্টিক মহাসাগর থেকে আসা দমকা বাতাসের বিরুদ্ধে টিকতে না পেরে সেখানকার অনেক পুরোনো কটেজ ও বসতঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

কোলাহলমুক্ত জীবন কাটাতে দ্বীপটিকে উপযুক্ত জায়গা মনে করেছিলেন কোয়ান ও তাঁর ভাইয়েরা। তাই তারা পুরোনো বাড়ি মেরামত করে সেখানে আবার বসতি গড়ে তোলেন। বর্তমানে ওয়ি দ্বীপে প্রায় ২০টি বসতঘর আছে। গ্রীষ্মের দিনগুলোতে ২০-৩০ জনের একটি মৌসুমি বাসিন্দা সেখানে থাকেন। কারণ, শীতে এখানে টিকে থাকা মুশকিল। এ ছাড়া একটি হোস্টেল রয়েছে, যেখানে ছয়জন থাকেন। তবে কোনো দোকান বা অন্যান্য সুবিধা নেই। নেই বিদ্যুৎ কিংবা সরবরাহ করা পানি। বিদ্যুতের জন্য গ্যাস ও সৌরশক্তি কাজে লাগান দ্বীপের বাসিন্দারা। বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য ঘরের ছাদে ট্যাঙ্কি রয়েছে। বাসিন্দারা চান না সেখানে বিদ্যুৎ বা অন্য কোনো সুবিধার বন্দোবস্ত হোক। কারণ তারা আধুনিকতার ছোঁয়ামুক্ত থাকতে চান।

৩০০ একরের ওয়ি দ্বীপে কোনো গাড়ি চোখে পড়ে না। সেখানে পৌঁছাতে হয় নৌকায়। দ্বীপের পেছনের অংশের মধ্যে রয়েছে মিঠাপানির হ্রদ। দক্ষিণের প্রান্ত ঘাসে ভরা ও উর্বর। সেখানে নতুন জীবনের চিহ্নের পাশাপাশি পুরোনো দিনের ধ্বংসাবশেষগুলো ভাঙা পাথরের আকারে রয়ে গেছে, যার মধ্যে আছে পুরোনো স্কুলঘর। দ্বীপের উত্তর প্রান্তটি উন্মুক্ত, পাথুরে ও অনুর্বর। সেখানে রয়েছে সমুদ্রের গুহাগুলো থেকে বেরোনো খাঁজকাটা খাড়া পাহাড়, উত্তরের বাতাসের আঘাতে আছড়ে পড়া ঢেউ থেকে উঠে আসা উল্লম্ব সমুদ্রের স্তূপ, যেগুলো দ্বীপটির নামকরণের সার্থকতা দেয়। সূত্র: বিবিসি

আরও পড়ুন

×