৫২০ কোটি টাকা শুল্ক-কর ফাঁকি
আবদুল মোনেম সুগারকে ৪৯ কোটি টাকা জরিমানা

লোগো
জসিম উদ্দিন বাদল
প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৪ | ০৭:২৮ | আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০২৪ | ১১:০৮
বন্ড সুবিধার আওতায় ছয় মাসে ১ লাখ ৬৫ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করেছে আবদুল মোনেম গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি। এসব চিনিতে প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় ৫২০ কোটি টাকা পরিশোধ শেষে বন্ডেড ওয়্যারহাউস থেকে খালাস নেওয়ার কথা। কিন্তু বন্ড কমিশনারেটকে না জানিয়ে অবৈধভাবে চিনিগুলো খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এমন অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটিকে ৪৯ কোটি টাকার অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে এ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে।
গতকাল বুধবার কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, ঢাকা (দক্ষিণ)-এর কমিশনার খালেদ মোহাম্মদ আবু হোসেন এ আদেশ দেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
তবে এ ক্ষেত্রে বন্ডের অপব্যবহার হয়নি বলে আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। তারা বলছে, আরডি বাবদ এনবিআরকে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করা হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ বন্ড কমিশনারের দেওয়া বিচারাদেশে বলা হয়েছে, আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি হোম-কনজাম্পশন বন্ডভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান। কাস্টমস আইন অনুযায়ী, হোম-কনজাম্পশনভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমদানি করার সময় শুল্ককর পরিশোধ ছাড়াই অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে বন্ড রেজিস্টারে ইনটু-বন্ড করে বন্ডেড ওয়্যারহাউসে গুদামজাত করা হয়। এই চিনির বন্ডিং মেয়াদ ছয় মাস। বন্ডেড লাইসেন্সের শর্তমতে, এক্স-বন্ড ডিক্লারেশন করে আইন অনুযায়ী বন্ড সুবিধায় আমদানি করা চিনিতে প্রযোজ্য শুল্ককর পরিশোধ করে তা দেশীয় চাহিদা মেটানোর জন্য খালাস নেওয়া হয়।
কিন্তু আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি বন্ড সুবিধায় আমদানি করা চিনি অবৈধভাবে অপসারণ করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে বলে অভিযোগ পায় বন্ড কমিশনারেট। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ এপ্রিল কমিশনারেটের একটি প্রতিনিধি দল প্রতিষ্ঠানটিতে সরেজমিন পরিদর্শনে যায়। এ সময় দেখা যায়, বন্ডেড ওয়্যারহাউসে কোনো চিনি নেই। অথচ ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি বন্ড সুবিধায় ৬০টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৮৪ দশমিক ৯৯ টন চিনি আমদানি করেছে। ২০২২ সালের ১৬ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ১৬ আগস্ট পর্যন্ত এই চিনি আমদানি করা হয়, যার শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ৯৭৮ কোটি ৭৯ লাখ ৫৬ হাজার ৮৯০ টাকা। যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর (কাস্টমস ডিউটি, রেগুলেটরি ডিউটি, ভ্যাট ও অগ্রিম কর) ৫২০ কোটি ৫৮ লাখ ৪ হাজার ৩৫০ টাকা। প্রতিনিধি দলের কর্মকর্তারা বন্ডেড ওয়্যারহাউসে চিনি মজুত না থাকার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের প্রশ্ন করলে তারা কোনো উত্তর দিতে পারেননি। এতে বন্ড কর্মকর্তাদের ধারণা, শুল্ককর ফাঁকি দিতে চিনি অবৈধভাবে অপসারণ করে বিক্রি করা হয়েছে। কাস্টমস আইনে বন্ড লাইসেন্সের শর্ত ও বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সিং বিধিমালা লঙ্ঘন হয়েছে। ফলে প্রযোজ্য শুল্ককর ছাড়াও বন্ডিং মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ থেকে প্রতিষ্ঠানের ফাঁকি দেওয়া শুল্ককরের ওপর সুদ প্রযোজ্য হবে।
জানা গেছে, অবৈধভাবে কাঁচামাল অপসারণ ও শুল্ককর ফাঁকি দেওয়ায় চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামাসংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি গত ১১ মে লিখিত জবাব দেয়। যাতে বলা হয়, বন্ড সুবিধায় আমদানি করা অপরিশোধিত চিনি গুদামজাত করা হয়। বন্ড লাইসেন্সপ্রাপ্তির পর থেকে তাদের প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে বন্ডিং সুবিধায় আমদানি করা কাঁচামাল চলমান মামলা ও কারণ দর্শানো নোটিশের আওতাভুক্ত হয়েছে। ফলে কারণ দর্শানো নোটিশে উল্লিখিত চিনি দেখানো হয়েছে। তাই অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডসহ যাবতীয় দলিল সংগ্রহ করে জবাব তৈরি করা এবং দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ওয়্যারহাউসের ইনভেন্টরি যাচাই করতে সময় প্রয়োজন। তা না হলে তাদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। নোটিশের জবাব ও ব্যক্তিগত শুনানিতে উপস্থিত থেকে তাদের তিন মাস সময় প্রয়োজন। একই কারণ দেখিয়ে গত ২৩ জুন, ২৪ জুলাই ও ১৫ আগস্ট তিনবার সময় বাড়ানোর আবেদন করা হয়।
সর্বশেষ গত ২৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত শুনানিতে আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী নাজমুল হাসান ও হেড অব কমার্শিয়াল আজিজুর রহমান চৌধুরী উপস্থিত হন। শুনানিতে উপস্থিত থাকা বন্ড কর্মকর্তারা বলেন, প্রতিষ্ঠানটির আমদানি করা অপরিশোধিত চিনি কোনো প্রকার এক্স-বন্ড ছাড়াই বা শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে ওয়্যারহাউস থেকে খালাস করেছে। এতে শর্ত ভঙ্গ হয়েছে, যাতে সুদসহ প্রযোজ্য শুল্ককর আদায়যোগ্য। তবে শুনানিতে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে লিখিত জবাব দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, শুল্ককর পরিশোধ ছাড়াই কাঁচামাল অপসারণ করা হয়েছে। তারা দণ্ডারোপ না করার অনুরোধ জানান। এই চিনিতে রেগুলেটরি ডিউটি কাস্টমস আইন অনুযায়ী যথাযথ নয় বলে প্রশ্ন তোলেন তারা। তবে কাস্টম হাউসে রেগুলেটরি ডিউটি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেননি।
বন্ড কমিশনার প্রতিষ্ঠানটির বক্তব্য, মামলার নথি, কারণ দর্শানো নোটিশ ও তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পর্যালোচনা করেন। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কাস্টমস আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানকে ৪৯ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেন। একই সঙ্গে অর্থদণ্ড ও শুল্ককর হিসেবে প্রযোজ্য মোট ৫৬৯ কোটি ৫৮ লাখ ৪ হাজার ৩৫০ টাকা পরিশোধের জন্য ১৫ দিনের সময় দিয়ে বিচারাদেশ জারি করেন। এ ছাড়া ফাঁকি দেওয়া শুল্ককরের ওপর কাঁচামালের বন্ডিং মেয়াদ অনুযায়ী সুদ প্রযোজ্য হবে।
এর আগেও প্রতিষ্ঠানটির বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছে এনবিআর। গত ২৪ এপ্রিল বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে কর ফাঁকি দেওয়া ৬৭৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা পরিশোধ না করায় আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারিসহ ব্যবসায়িক গ্রুপটির সব প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছিল এনবিআর। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির চলতি অ্যাকাউন্টসহ অন্য সব অ্যাকাউন্ট অপরিচালনযোগ্য বা জব্দ করতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
এ বিষয়ে আবদুল মোনেম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম মহিউদ্দিন মোনেম সমকালকে বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে এখনও বিস্তারিত জানি না। তবে আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারির হেড অব কমার্শিয়াল আজিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, প্রকৃতপক্ষে এখানে বন্ডের অপব্যবহার হয়নি। আরডি বাবদ এনবিআরকে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করা হয়েছে। ওই অর্থ দাবি করা থেকে শুল্ককরের সঙ্গে সমন্বয় করার অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু এনবিআর তা আমলে নেয়নি।