এনবিআরে শাটডাউন: সারাদেশে বন্ধ আমদানি-রপ্তানি ও শুল্ক কার্যক্রম

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৫ | ১৮:১১ | আপডেট: ২৮ জুন ২০২৫ | ১৯:১৯
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের অপসারণ ও সব পক্ষের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে রাজস্ব খাত সংস্কারের দাবিতে চলছে শাটডাউন কর্মসূচি। আজ শনিবার সকাল থেকে এনবিআরে কোনো কাজ হয়নি। ভবনের ভেতরে কেউ ঢুকতে বা বের হতে পারেননি। আজ বন্ধ ছিল এনবিআরের সব সেবা।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর, বেনাপোল, হিলি বন্দর, বুড়িমারি স্থলবন্দর, আখাউরা স্থলবন্দর, ঢাকা কাস্টমস হাউসসহ দেশের সব কাস্টমস হাউস ও শুল্ক স্টেশনে কার্যক্রম বন্ধ। এতে বন্ধ আছে আমদানি–রপ্তানিতে সব ধরনের শুল্কায়ন কার্যক্রম।
আজ সকালে ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি শুরু করেন আন্দোলনরত কর্মকর্তা–কর্মচারীরা। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে এই আন্দোলন চলে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সকাল থেকে এনবিআরের ঢাকা কার্যালয়ের কর্মকর্তাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কর্মকর্তারা আগারগাঁও এনবিআর ভবনের সামনে সমবেত হন। এনবিআরের সামনের রাস্তায় কয়েক শ’ কর্মকর্তা-কর্মচারী অবস্থান করছেন। এনবিআরের তিনটি ফটকে তালা ঝুলছে।
এনবিআরের মূল ফটক বন্ধ করে দিয়ে ভেতরে অবস্থান নিয়েছেন বিজিবি, পুলিশ, র্যাব ও কোস্টগার্ডের সদস্যরা। এনবিআর ভবনের আশপাশে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। কার্যত অবরুদ্ধ রয়েছে এনবিআর কার্যালয়।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ, এনবিআর চেয়ারম্যান সমস্যার সমাধান না করে মিথ্যাচার করছেন। এ পরিস্থিতিতে আজ থেকে সারা দেশের শুল্ক কর কার্যালয়েও শুরু হয়েছে লাগাতার শাটডাউন কর্মসূচি।
চট্টগ্রাম বন্দর
আজ ভোর ছয়টা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি-রপ্তানি পণ্যের শুল্কায়নও বন্ধ হয়ে যায়। সকাল থেকে এ কর্মসূচি শুরুর পর থেকে বন্দরে পণ্য খালাস কার্যক্রমে বিঘ্ন তৈরি হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশ করতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল পণ্যবাহী ট্রাক। বন্দরের জেটির ভেতরেও পণ্য বোঝাইয়ের অপেক্ষায় জট তৈরি হয় গাড়ির।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, আমদানি-রপ্তানি পণ্যের শুল্কায়ন বন্ধ হলেও আগে নিবন্ধন হওয়া জাহাজ থেকে বন্দরে কনটেইনার ওঠানো-নামানো কার্যক্রম চালু রয়েছে। নিবন্ধনহীন নতুন জাহাজ জেটিতে আসলে শাটডাউন কর্মসূচির আওতায় পড়বে। তখন বন্দরের কার্যক্রমেও প্রভাব পড়বে ব্যাপক হারে।
ঢাকায় ব্যবসায়ী নেতাদের জরুরি সংবাদ সম্মেলন
শীর্ষস্থানীয় ১৩টি ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে আজ শনিবার রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে যৌথভাবে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে নেতারা বলেছেন, এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবি সমর্থন করেন না তারা। দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, চেয়ারম্যানকে অপসারণ কোনোভাবে কাম্য নয়। কারণ, আজ চেয়ারম্যান কাল হয়তো সংস্থার অন্য কোনো সদস্যের অপসারণের দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু হবে। ফলে সমস্যা বাড়তে থাকবে। উদ্ভূত পরিস্থিতির সমাধানে মঙ্গলবার নয়, আজই সরকারকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
বেনাপোল স্থলবন্দর
কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির কারণে বন্ধ রয়েছে বেনাপোল কাস্টমস হাউস। আজ শনিবার বন্ধ রয়েছে কাস্টমসে পণ্য শুল্কায়ন পরীক্ষণ ও লোড-আনলোড। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। বাড়ছে পণ্যজট। আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে পড়ছে বিরূপ প্রভাব।
বেনাপোল কাস্টম হাউসের চেকপোস্ট কার্গো শাখার রাজস্ব অফিসার আবু তাহের সমকালকে বলেন, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির কারণে সকাল থেকে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। কাস্টমসের কোথাও কাজ হচ্ছে না।
মোংলা বন্দর
‘কমপ্লিট শাটডাউনে’র অংশ হিসেবে মোংলা কাস্টম হাউজ খোলা থাকলেও বন্ধ রয়েছে সেবা কার্যক্রম। মোংলা কাস্টমস হাউসের কমিশনার মু. শফিউজ্জামান জানান, শাটডাউন কর্মসূচির ফলে এখানে স্বাভাবিক কোনো কার্যক্রম চলেনি। তবে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র ও বোর্ড জনসংযোগ বিভাগের উপ-পরিচালক মাকরুজ্জামান সমকালকে জানান, নতুন করে সেবা দেওয়া বন্ধ থাকলেও বন্দরে জাহাজে পণ্য উঠা-নামার কাজ স্বাভাবিক ছিল।
আখাউড়া স্থলবন্দর
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরে কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলছে। তবে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে গেছে আটা ও মাছের ২৬টি ট্রাক। কাস্টমস কর্মকর্তরা বলছেন, ২৬টি ট্রাকের কাগজপত্র আগের দিন স্বাক্ষর করা হয়েছিল।
সরেজমিনে স্থলবন্দরে দেখা যায়, কর্মচাঞ্চল্য নেই বন্দরে। ব্যবসায়ীদেরও আনাগুনা তেমন একটা চোখে পড়েনি। বন্দরের শূন্যরেখায় আগরতলায় যেতে মাছ ও আটা ভর্তি ট্রাক সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কাস্টমস অফিসে দেখা গেছে, কর্মকর্তারা অলস বসে আছেন। একজন অন্যজনের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটাচ্ছেন।
সোনামসজিদ স্থলবন্দর ও রহনপুরের শুল্ক স্টেশন
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) শাটডাউন কর্মসূচির কারণে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সোনামসজিদ স্থলবন্দর এবং রহনপুর শুল্ক স্টেশন দিয়ে সব ধরনের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। শুল্কায়ন বন্ধ থাকায় আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এতে করে জিরো পয়েন্টে আটকা পড়েছে পণ্যবাহী ট্রাক।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ জিরো পয়েন্টে অবস্থিত কাষ্টমস ভবনের মূল ফটক বন্ধ করে দিয়ে ভেতরে অবস্থান করছেন সেখানে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। ভবনের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের কর্মসূচি সম্বলিত শাটডাউনের ব্যানার।
বন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেডের ম্যানেজার মঈনুল ইসলাম সমকালকে জানান, এনবিআর ঘোষিত শাটডাউনের কারনে বন্দরে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকলেও বন্দরের ভেতর উভয় দেশের ট্রাক থেকে পণ্য খালাস অব্যাহত রয়েছে।
ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা এস আই জামিরুল ইসলাম জানান, আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকলেও যাত্রী পারাপার চালু রয়েছে।
অন্যদিকে রহনপুর শুল্ক স্টেশনেও সব ধরনের আমদানি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বলে জানান রহনপুর স্টেশন ম্যানেজার আবদুল্লাহ আল মামুন সেখানেও কাস্টমস কর্মরতরা তাদের কার্যালয়ে ব্যানার টাঙিয়ে প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন।
হিলি স্থলবন্দর
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ও ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচিতে বন্ধ হয়েছে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরের কার্যক্রম। ফলে আমদানিকৃত পণ্য বোঝাই ট্রাক বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় দঁড়িয়ে রয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক সেবা চালু থাকায় হিলি ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে পাসপোর্টধারী যাত্রী পারাপার স্বাভাবিক রয়েছে।
হিলি কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা নাজমুল হক বলেন, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আমরা আছি এবং আমাদের সমর্থন আছে। তাই, হিলি কাস্টমসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মস্থলে উপস্থিত থাকলেও ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করছেন।
হিলি কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফেরদৌস জানান, সকাল থেকে হিলি স্থলবন্দরের ব্যাবসায়ীরা ভারত থেকে ৩৫ গাড়ি পণ্য আমদানি করেছেন। কিন্তু সেগুলো শুল্কায়ন ও পরীক্ষণ বন্ধ রয়েছে। আজকে সন্ধ্যার মধ্যে কোনো ইতিবাচক ঘোষণা না আসলে আগামীকাল রোববার থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ থাকবে।
এ ব্যাপারে সোনামসজিদ কাস্টমসে কর্মরত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে তাদের রহনপুর ও সোনামসজিদে ধর্মঘট চলছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
সব পক্ষের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে রাজস্ব খাতের সংস্কার এবং এনবিআরের চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে আজ ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি পালন করছেন সংস্থাটির আন্দোলনরত কর্মকর্তা–কর্মচারীরা। পাশাপাশি আজ থেকে সারা দেশের শুল্ক–কর কার্যালয়ে শুরু হয়েছে লাগাতার ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি।
এদিকে আজ বিকেলে আগামীকাল রোববারও ‘শাটডাউন’ ও ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি চলবে বলে ঘোষণা দেন এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার। তিনি বলেন, এনবিআরের বর্তমান চেয়ারম্যানকে দায়িত্বে রেখে গত ২৫ মে সরকার প্রেস বিজ্ঞপ্তির আলোকে রাজস্ব সংস্কার সম্ভব নয়। স্পষ্টতই ফ্যাসিবাদের দোসর একটি বিশেষ গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নে প্রতিভূ হিসেবে কাজ করছেন। এই পরিস্থিতিতে কর্মসূচি চালিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।