কিংবদন্তির বিদায়

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী [জন্ম :১২ ডিসেম্বর ১৯৩৪ মৃত্যু :১৯ মে ২০২২]
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৯ মে ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৯ মে ২০২২ | ১৬:০২
তাঁর কীর্তি অনেক। আমৃত্যু সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কলামিস্ট হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এই মানুষটি সাহিত্যচর্চার শুরুর দিকে লিখেছেন অনেক কবিতা। লিখেছেন গল্প-উপন্যাসও। এই সব কীর্তি ছাপিয়ে সবার আগে তাঁর যে সৃষ্টির কথা মনে আসে, তা তিনি রচনা করেছিলেন কলেজের গণ্ডি পেরুবার আগে, ১৯৫২ সালের রক্তঝরা একুশে ফেব্রুয়ারির অভিঘাতে। সেই কবিতা থেকে সুরারোপিত গান জীবদ্দশাতেই তাঁকে কিংবদন্তিতে পরিণত করে দিয়েছিল। যতকাল জাতি হিসেবে বাঙালি টিকে থাকবে, ততকাল গীত হবে তাঁর লেখা- 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি'।
কালজয়ী এই গানের কবি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে লন্ডনের নর্থ উইক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। মাস দুয়েক আগে ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালেই মারা যান তাঁর মেয়ে বিনীতা চৌধুরী। তাঁর চার মেয়ে এবং এক ছেলের মধ্যে বিনীতা ছিলেন তৃতীয়। বাবার সঙ্গে তিনি লন্ডনের এজওয়ারের বাসায় থাকতেন, তার দেখাশোনা করতেন। বড় মেয়ে তনিমা চৌধুরীকে উদ্ৃব্দত করে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম বলেন, 'গত কিছুদিন ধরে গাফ্ফার চৌধুরী হাসপাতালে ছিলেন। বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে মৃত্যু হয়েছে বলে তাঁর মেয়ে আমাকে জানিয়েছেন। আমরা গভীরভাবে শোকাহত।'
একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারে সম্মানিত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশালের উলানিয়া জমিদার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী ও মা জহুরা খাতুন। শিক্ষাজীবনের শুরু হয় উলানিয়া জুনিয়র মাদ্রাসায়। সেখানে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করে চলে যান বরিশাল শহরে। ভর্তি হন আসমত আলী খান ইনস্টিটিউটে। বাবার মৃত্যুতে সে সময় আর্থিক অনটনের শিকার হয়ে উপার্জনের পথ খুঁজতে হয়। স্কুলজীবনেই 'কংগ্রেস হিতৈষী' পত্রিকায় কাজ শুরু করেন তিনি। সাহিত্যচর্চার শুরু তখন থেকে এবং ১৯৪৯ সালে সেই সময়কার বিখ্যাত 'সওগাত' পত্রিকায় ছাপা হয় তাঁর লেখা গল্প।
১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। ওই বছরেই 'দৈনিক ইনসাফ' পত্রিকায় যোগদানের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণভাবে সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়েন। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় থেকে ইতিহাসের বাঁকবদলের সাক্ষী হয়ে উঠতে শুরু করেন তিনি। যুক্ত হন ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী হাসপাতালে গিয়েছিলেন আহত সহযোদ্ধাদের দেখতে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিল ভাষাসৈনিক রফিকের লাশ। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী পরবর্তীকালে বলেছিলেন, ওই লাশটি দেখে তাঁর মনে হয়, এ যেন তাঁর নিজের ভাইয়ের রক্তমাখা লাশ। তক্ষুণি কবিতার প্রথম দুটি লাইন তাঁর মনে আসে। পরে কয়েকদিন ধরে লেখা ওই কবিতাটি ভাষা আন্দোলনের প্রথম লিফলেটে 'একুশের গান' শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত 'একুশে সংকলনে'ও এটি প্রকাশিত হয়। কবিতাটিতে প্রথম সুরারোপ করেছিলেন আব্দুল লতিফ। পরে ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ গানটিতে সুর করেন। তাঁর সুরারোপিত গানটি ব্যবহূত হয় জহির রায়হানের 'জীবন থেকে নেয়া' চলচ্চিত্রে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এ গান অপরিমেয় অনুপ্রেরণার উৎস হয়েছে। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে এই গান গাওয়া হয়। বিবিসির শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থান লাভ করেছে।
ঢাকা কলেজের পর পড়তে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই সময়ে সাংবাদিকতার সমান্তরালে সাহিত্য সৃষ্টিতে সক্রিয় ছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত গল্পের বই 'সম্রাটের ছবি'। পঞ্চাশের ও ষাটের দশকেই তিনি লিখেছেন 'কৃষ্ণপক্ষ' (১৯৫৯), 'চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান' (১৯৬০), 'নাম না জানা ভোর' (১৯৬২), 'নীল যমুনা' (১৯৬৪), 'শেষ রজনীর চাঁদ' (১৯৬৭), 'সুন্দর হে সুন্দর' (১৯৬০) ইত্যাদি।
ঢাকা কলেজে পড়ার সময় ১৯৫১ সালে 'সংবাদ' প্রকাশ পেলে 'ইনসাফ' ছেড়ে তাতে যোগ দেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। পরে 'মাসিক সওগাত' থেকে 'দৈনিক আজাদ' হয়ে 'ইত্তেফাক' পত্রিকায় যোগ দেন। মাঝে একবার সাংবাদিকতা ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৬৪ থেকে দু'বছর ছাপাখানার ব্যবসা করে আবারও সাংবাদিকতায় ফিরে এসে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে 'দৈনিক আওয়াজ' বের করেন। এর বছর দুয়েক পর ১৯৬৭ সালে আবার তিনি 'দৈনিক আজাদ'-এ ফিরে যান সহকারী সম্পাদক হিসেবে। ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র 'জয়বাংলা'য় নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বের করেছিলেন 'দৈনিক জনপদ'। ১৯৭৪ সালে স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গিয়ে আর কখনও স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসেননি। এরপর শুরু হয় তাঁর দীর্ঘ প্রবাস জীবন। প্রবাসে থেকেও ঢাকার পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত লিখে গেছেন রাজনৈতিক ধারাভাষ্য আর সমকালীন বিষয় নিয়ে। সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও লিখেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক এবং স্মৃতিকথা।
জীবনের শুরুটা বরিশালে এবং শেষটা লন্ডনে কাটালেও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ঢাকায় কাটানো জীবনকেই সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেন। তা তাঁর স্মৃতিকথা 'ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা' নামকরণ থেকে বোঝা যায়। এ নিয়ে সাংবাদিক শেখ রোকন তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, 'আপনার শৈশব-কৈশোর কেটেছে মেঘনাতীরে, পাঁচ দশক ধরে বসবাস করছেন টেমসতীরে; কিন্তু আত্মজীবনীতে বুড়িগঙ্গা কেন?' টেলিফোন আলাপচারিতার বর্ণনা দিয়ে রোকন লিখেছেন, 'সুদূর লন্ডন থেকে হাসির ঢেউ ঢাকায় আছড়ে ফেলে গাফ্?ফার ভাই বললেন, গাফ্?ফার চৌধুরীকে তৈরি করেছে বুড়িগঙ্গা, আর কোনো নদী নয়।'
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক: আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, 'কালজয়ী গান ও লেখনীর মাধ্যমে প্রত্যেক বাঙালির হৃদয়ে চির অম্লান হয়ে থাকবেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশ প্রগতিশীল, সৃজনশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একজন অগ্রপথিককে হারাল।'
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, 'গাফ্?ফার চৌধুরী তাঁর মেধা-কর্ম ও লেখনীতে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখেছেন ও বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মননকে ধারণ করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে সমর্থন করে জাতির সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন।'
মিরপুরে স্ত্রীর কবরের পাশে শায়িত করা হবে: আবদুল গাফ্?ফার চৌধুরীর অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী ঢাকার মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে স্ত্রীর পাশে সমাহিত করা হবে তাকে।