এমএসএফের প্রতিবেদন
নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ৪১৪টি, কারা হেফাজতে ৮ মৃত্যু

প্রতীকী ছবি
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২২ | ০৫:১২ | আপডেট: ৩১ মে ২০২২ | ০৫:১২
দেশে ধর্ষণসহ নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং মতামত প্রকাশের অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মতো বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতন, হয়রানি, কারা হেফাজতে মৃত্যু বেড়েছে।
দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে করা এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) ‘মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদন মে, ২০২২’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনটি আজ মঙ্গলবার প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারে এমএসএফের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুলতানা কামালের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ ঘটনাগুলো ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় এমএসএফ গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ৪১৪টি
এমএসএফের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের মে মাসে দেশে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা; ধর্ষণ, হত্যা ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বিগত মাসগুলোর তুলনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেড়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। মে মাসে ৪১৪টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যা গত মাসের তুলনায় ৪৭টি বেশি। এ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ৮৪টি, বিগত মাসে যা ছিল ৭১টি। সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ২২টি, যা এপ্রিল মাসে ছিল ১৪টি, ধর্ষণ ও হত্যা ৪টি। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে চারজন কিশোরীসহ ১০ জন প্রতিবন্ধী ও দলবদ্ধ ধর্ষণ শিকার হয়েছে প্রতিবন্ধী একজন কিশোরী ও দুজন নারী।
এমএসএফ মনে করে, দেশে যথেষ্ট কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা লক্ষণীয় নয়। এ কারণে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। সামাজিক সুরক্ষায় সরকারের নজরদারি জোরদার করা প্রয়োজন।
দেশের ১২টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। ফাউন্ডেশন বলছে, ১ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনার ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা। প্রায় প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই স্থানীয় হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারদের মাধ্যমে তা যাচাই করা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার
এমএসএফের প্রতিবেদন বলছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রবলভাবে সমালোচিত। এ আইনে মামলার নামে হয়রানি কমেনি। ধারাবাহিকভাবে এর অপব্যবহার বেড়েই চলেছে। মে মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি মামলায় একজন সাংবাদিকসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এমএসএফ মনে করে, দণ্ডবিধি আইনে মামলা না করে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করার মধ্য দিয়ে এর যথেচ্ছ অপব্যবহারের চিত্রটি সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। এটি হয়রানিমূলক ও অগ্রহণযোগ্য।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ
মে মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগের দুটি ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে একজনের মৃত্যু, পুলিশের গ্রেপ্তারকালে ধাওয়া খেয়ে দুজন পানিতে ঝাঁপ দিলে মৃত্যুবরণ করেন। এ দুটো ঘটনায়ই পুলিশের অমানবিক আচরণ দৃশ্যমান। তা ছাড়া পুলিশ কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছে এক কিশোরী, চায়ের দোকানির নিকট থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নিয়েছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা, হাসপাতালের অভ্যন্তরে আনসার বাহিনীর সদস্য কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিন রোগীর স্বজনেরা। এ ধরনের ঘটনাগুলো গুরুতর অপরাধ, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
এমএসএফ মনে করে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন কর্মকাণ্ড আইনবহির্ভূত ও চরম উদ্বেগের বিষয়। এসব ঘটনা নাগরিক জীবনে চরম উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করছে। তাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি মানুষ আস্থা হারাচ্ছে।
কারা হেফাজতে ৮ মৃত্যু
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন বলছে, মে মাসে কারা হেফাজতে আটজনের মৃত্যু হয়েছে, যা গত মাসের তুলনায় তিনজন বেশি। কারা হেফাজতে মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজন কয়েদি ও এক নারীসহ পাঁচজন হাজতি রয়েছেন। কারাগারে অপর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে বন্দিরা অসুস্থ হলে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই অধিকাংশ বন্দির মৃত্যু হয়। এমএসএফ বিশ্বাস করে, কারাগারের অভ্যন্তরে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি হেফাজতে মৃত্যুর সঠিকভাবে তদন্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।
সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশে হামলা
এমএসএসের প্রতিবেদন বলছে, মে মাসে বেশকিছু ঘটনায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ২৭ সাংবাদিককে কাজে বাধা প্রদান, হয়রানি, নির্যাতন, হামলা, প্রাণনাশের হুমকি ও অপহরণের চেষ্টা করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং নাশকতার মামলায় দুই সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অপর এক সাংবাদিক পুলিশ কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। একজন সাংবাদিক সরকারি গাড়িচাপায় নিহত হয়েছেন। জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকার রক্ষায় সাংবাদিকেরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। কিন্তু সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে যেভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এটি শুধু অগ্রহণযোগ্যই নয়, বরং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত।
এমএসএফ মনে করে, সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে যেভাবে বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং তাঁদের যেভাবে হামলা, হুমকি, হয়রানি ও শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে, তা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, বরং বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ করার শামিল, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
- বিষয় :
- ধর্ষণ
- নারী ও শিশু
- সহিংসতা