দুই বীরাঙ্গনার জবানে রাজাকার মুকিত মনিরের গণহত্যা

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২২ | ১১:০১ | আপডেট: ২২ জুন ২০২২ | ১১:০১
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার রাজাকার মুকিত মনির ওরফে মুকিত মিয়াসহ ১১ আসামির বিরুদ্ধে জবানবন্দি দিয়েছেন দুই বীরাঙ্গনা। তারা হলেন- রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম ও দ্বিতীয় সাক্ষী শাল্লার দৌলতপুরের দাউদপুর গ্রামের জামিলা এবং দিরাই উপজেলার পেরুড়া বক্তারপুর গ্রামের কুলসুম বিবি।
বুধবার বিচারপতি মো. শাহীনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়।
মুকিত মনির সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুহাম্মদ শিশির মনিরের বাবা। শিশির মনির ২০০৯ সালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন বলে সমকালকে জানিয়েছেন প্রসিকিউটর রেজিয়া সুলতানা চমন।
জবানবন্দি গ্রহণ শেষে সাক্ষীদের জেরা করেন আসামি পক্ষের আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন। পরে ট্রাইব্যুনাল আগামী ১৬ আগস্ট এই মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেন।
ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে প্রত্যক্ষ প্রথম সাক্ষী বীরাঙ্গনা জমিলা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৭ অগ্রহায়ণ বাবা-মাসহ বসতবাড়িতে তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। অবিবাহিত ছিলেন তিনি। ভোররাত আনুমানিক ৪টার দিকে মুকিত, তোতা টেইলর, তোতন মাস্টার, কদর, জোবায়ের মনির, প্রদীপ মনির, জাকির হোসেনসহ অনেকে তাদের বাড়ি ঘেরাও করে। এরপর ঘরে ঢুকে বাবা-মা, ভাই দুলাল ও তাকে ধরে নিয়ে প্রতিবেশী আপ্তর আলীর বাড়ির উঠানে যায়। সেখানে আপ্তর, আজিজ, আতিব, বোচন, ইয়াকিনকে রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করে। ওই সময় আব্দুর রহিম, নওয়াব আলী, কুদ্দুস ও বৈকণ্ঠ ভয়ে পালিয়ে যান। এরপর মুকিত ও কদর তাকে ঘরে নিয়ে ধর্ষণ করে। রাজাকাররা বাড়িঘরে লুটপাট করে এবং মুক্তা, পেয়ারা ও জাহেরাকে ধরে শ্যামচর বাজারের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তারা কুলসুম নামে একজনকে আটক অবস্থায় পান। ওই ক্যাম্পে সপ্তাহখানেক আটকে রেখে তাদের সবাইকে ধর্ষণ করা হয়। এরপর মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প থেকে তাদের উদ্ধার করে। ১৫-১৬ দিন পর মুক্তা জানায়, ধর্ষণের ফলে সে অন্তঃসত্ত্বা। পরবর্তীতে মুক্তার একটি কন্যাসন্তান হয়, যার নাম রাখা হয় হালিমা।
এরপর ট্রাইব্যুনালে দ্বিতীয় প্রত্যক্ষ সাক্ষী কুলসুম বেগম তার জবানবন্দিতে বলেন, ১৭ অগ্রহায়ণ আনুমানিক সকাল ৯টার দিকে রাজাকার মুকিত, হাসিম মাস্টার, জোবায়ের মনির, প্রদীপ, কদর, জাকির হোসেন, সিদ্দিক, তোতা টেইলর, তোতন মাস্টার, জলিল, রশিদের নেতৃত্বে অন্তত ১০০ জন আমাদের গ্রাম ঘেরাও করে। স্বামীর বাড়িতে ছিলাম আমি। রাজাকাররা রামা মাস্টার, চিত্তরঞ্জন, তার মা কালী সুখলালসহ সাত-আটজনকে ধরে সুরমা নদীর পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেয়। আর এই হত্যাযজ্ঞ বাড়ির পাশের জঙ্গলে পালিয়ে থেকে স্বামীসহ দেখেছেন বলে ট্রাইব্যুনালকে জানান কুলসুম বেগম।
তিনি আরও বলেন, একই দিন দুপুর ১২টার দিকে রাজাকাররা পেরুড়া গ্রামের অন্য একটি হিন্দুপাড়ার পুরুষ, নারী, শিশুসহ ৩০-৪০ জনকে ধরে নিয়ে জোর করে মুসলমান বানায়। এরপর পুরুষদের গুলি করে হত্যার পর লাশ সুরমা নদীতে ফেলে দেয়। টের পেয়ে রাজাকাররা জঙ্গল থেকে স্বামীসহ তাঁকে ধরে নিয়ে সুরমা নদীর পাড়ে যায়। সেখানে স্বামীকে গুলি করে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেয়। কুলসুমকে আটক করে শ্যামাচর বাজার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে মুক্তা, পেয়ারা ও জাহেরাকে দেখতে পান কুলসুম। এরপর রাজাকাররা ক্যাম্পে আটক রেখে তাঁদের ধর্ষণ করে। ছয় দিন পর মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প থেকে তাদের উদ্ধার করেন।