ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

মানব পাচার মামলা

সাজা কম, খালাস বেশি

সাজা কম, খালাস বেশি

ফাইল ছবি

ওয়াকিল আহমেদ হিরন

প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ | ০৮:২২

ভুলভাবে মামলা দায়ের, দুর্বল তদন্ত ও সাক্ষী হাজির করতে না পারায় মানব পাচার আইনের অধিকাংশ মামলায় অপরাধীদের শাস্তি হচ্ছে না। এ আইনে আসামির জামিন হওয়ার বিধান না থাকলেও বেশিরভাগই এ সুযোগ পাচ্ছে। ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেই যাচ্ছে মানব পাচারকারীরা।

সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমার পরও মানব পাচার মামলার ৯৬ ভাগই আদালতে বিচারাধীন। এসব মামলা নিষ্পত্তির হার মাত্র ৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। বিচার শেষে ১৫ শতাংশ মামলায় আসামির সাজা হয়েছে, খালাস পেয়েছে ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে।

খালাস দেওয়া একাধিক মামলার রায়ে আদালত উল্লেখ করেন, সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে ব্যর্থতার কারণে কোনো ফৌজদারি মামলা বছরের পর বছর বিচারাধীন থাকা আইনগত বা যুক্তিসংগত নয়। মামলার বিচারে এ রকম বিলম্ব ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। তাই আসামিদের খালাস দেওয়া যুক্তিযুক্ত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানব পাচারকারীরা অত্যন্ত শক্তিশালী। আর পাচারের শিকার ব্যক্তি আর্থিকভাবে দুর্বল বিচারপ্রার্থী। নানা আইনি জটিলতায় দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার ফলে এক সময় আদালতে মামলা চালাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন তাঁরা। ফলে দুর্বল তথ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে আইনি লড়াই পরিচালনা করতে গিয়ে অধিকাংশ মামলাতেই অপরাধীরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে।

সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন আদালতে মানব পাচারের অধিকাংশ মামলার বিচার কার্যক্রম চলছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। মামলার উপাদান, সাক্ষ্য ও তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে না পারায় তদন্ত কর্মকর্তারা যথাসময়ে কাজ শেষ করতে পারছেন না। মানব পাচার আইনে করা মামলায় ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে অভিযোগ গঠন এবং ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার শেষ করার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু তদন্তে ধীরগতির কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। বছরের পর বছর ধরে ঝুলছে এসব মামলার কার্যক্রম।

মানব পাচার আইনের মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার জন্য সাতটি বিভাগীয় শহরে রয়েছে মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্যানুসারে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মানব পাচারের ৭ হাজার ২৩৩টি মামলা দায়ের হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে বিভিন্ন আদালতে ৩৬৮টির নিষ্পত্তি হয়েছে আর বিচারাধীন ৫ হাজার ৯৭০টি (তদন্তাধীন মামলাসহ)। পুলিশি তদন্ত শেষে বিচারের জন্য বিভিন্ন আদালতে ঝুলছে ৫ হাজার ৭৭টি মামলা। এখন পর্যন্ত এ-সংক্রান্ত মামলায় ১১ জনের মৃত্যুদ াদেশ হয়েছে, যাবজ্জীবন কারাদ হয়েছে ৩০৬ জনের। বিভিন্ন মেয়াদে ৮৬ জনের সাজা হয়েছে।

কেন সাজা হয় না : চাঁদপুর হাজীগঞ্জ উপজেলার উচ্চাঙ্গা গ্রামের রাজেন্দ্র চন্দ্র রায়কে কানাডা পাঠানোর নাম করে ২০১৭ সালে ৪ লাখ টাকা অগ্রিম নেন ওই এলাকার হারাধন পাল, সমীর পাল ও মনোরঞ্জন দাস। এ নিয়ে প্রতারিত হওয়ার পর ২০২১ সালের মার্চে রাজধানীর রমনা থানায় মানব পাচার আইনে মামলা করেন রাজেন্দ্র। পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও মামলা করা হয়। তদন্ত শেষে সম্প্রতি পুলিশ তিনজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করে। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ১১ জানুয়ারি মামলাটি খারিজ করে দেন ঢাকা বিভাগীয় মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল।

ওই ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি কে এম সাজ্জাদুল হক শিহাব সমকালকে বলেন, ওই অপরাধ মানব পাচার আইনের আওতায় আসেনি। ভুলভাবে মামলাটি করা হয়েছিল। তাই মামলাটি খারিজ করে দিয়েছেন বিচারক। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এখানে কোনো মানব পাচার হয়নি, প্রতারণা হয়েছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসন আইনে মামলাটি দায়ের করা উচিত ছিল। এমন ভুলভাবে অসংখ্য মানব পাচার মামলা দায়ের করার কারণে আসামিদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে তারা।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী সমকালকে বলেন, মানব পাচারের মামলার ফলাফল খুবই হতাশাব্যাঞ্জক। সাক্ষী সুরক্ষা আইন না থাকায় মামলার সাক্ষীরা আদালতে যেতে ভয় পান। বাদীকে বিবাদীপক্ষের লোকজন ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থের মাধ্যমে আপস-মীমাংসা করে ফেলে। তিনি বলেন, পুলিশও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে পারে না। এজন্য প্রয়োজন 'নিরপেক্ষ তদন্ত সেল' গঠন। সাক্ষীকে আনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দিতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে ঘটনার ভিডিও ফুটেজ যুক্ত করে মামলার তদন্ত শেষ করতে হবে।

মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে সংঘবদ্ধভাবে মানব পাচারের জন্য মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও সর্বনিম্ন ৭ বছরের কারাদণ্ড এবং অনূ্যন ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।

ব্লাস্টের সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না সমকালকে বলেন, প্রতি বছর অসংখ্য নারী-শিশু পাচার হয়ে যাচ্ছে। বিদেশে চাকরির আশায় গিয়ে নির্যাতন ও প্রতারণার শিকার হচ্ছে। কিন্তু অপরাধীর বিচার হচ্ছে না। তিনি বলেন, মানব পাচারের মামলায় আজ পর্যন্ত কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি বা ট্রাভেল এজেন্সির সাজা হয়নি। কারণ অর্থের কাছে এসব আইন কিছুই না। আইন আছে কিন্তু যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। ন্যায়বিচার বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। আইন সবার জন্য নয়, অসহায় ও গরিব মানুষের বিরুদ্ধে প্রয়োগের জন্য।

তিনি বলেন, আমাদের দেশের আইন মাকড়সার জালের মতো। ছোটরা ধরা পড়ে, বড়রা নয়। এভাবেই বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে।

ঢাকার ট্রাইব্যুনালের চিত্র : ২০২০ সালের মার্চে ঢাকা বিভাগীয় মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয়। বর্তমানে এখানে নতুন-পুরোনো ৯৩৪টি মামলা বিচারাধীন। প্রতি বছর ৩০০-৪০০ মামলা এ ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা হয়। ২০২২ সালে নিষ্পত্তি হয়েছে ৬৪৮টি মামলা। এর মধ্যে ১১টি মামলায়

যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে, কিন্তু কোনো মৃত্যুদণ্ডাদেশ নেই। এ ছাড়া অর্থদণ্ড সাজাসহ বিভিন্নভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে আরও ৯৩টি মামলা। সাক্ষীদের অনুপস্থিতির কারণে বাকি ৫ শতাধিক মামলার আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

এখানে ২০২১ সালে ৪০৮টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি মামলায় সাজা হয়েছে। খালাস পেয়েছে ৩৫৩ মামলার আসামি। ২০২০ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নিষ্পত্তি হওয়া ৩৯টি মামলার মধ্যে কোনো আসামির সাজা হয়নি। সবাই খালাস পেয়েছে। সংশ্নিষ্টরা জানান, এই ট্রাইব্যুনালে ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের পুরোনো মামলা বিচারাধীন রয়েছে।

ঢাকা বিভাগীয় মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর সাজ্জাদুল হক শিহাব সমকালকে বলেন, ইতোমধ্যেই অনেক মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে সাজার পরিমাণ খুবই কম। মামলা বিলম্বে নিষ্পত্তি হওয়ার প্রধান কারণ যথাসময়ে আদালতে সাক্ষী আসে না। মামলার বাদী ও সাক্ষীর ঠিকানাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁদের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকে।

তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনেও অনেক ত্রুটি থাকে। অনেক মামলায় সাক্ষীরা আদালতে এসে আপসের কথা বলেন। আবার তাঁরা আদালতে এসে আসামির পক্ষে সাক্ষী দেন। আদালত ও পুলিশের পক্ষ থেকে সব প্রক্রিয়া গ্রহণ করার পরেও সাক্ষীরা হাজির হন না। দীর্ঘদিন সাক্ষীর অভাবে অনেক মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যায় এবং আসামিরাও খালাস পেয়ে যায়। সন্দেহাতীতভাবে অপরাধ প্রমাণিত না হলে কোনো আসামির সাজা হয় না। এতে নষ্ট হয় রাষ্ট্র্রের অর্থ, আদালতের সময়।
এদিকে মানব পাচার মামলার তদন্ত প্রসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্নিষ্টদের মতে, মামলার চার্জশিটে আসামিদের সঠিক নাম-ঠিকানাসহ তদন্তের বিস্তারিত উল্লেখ থাকে না। তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করে সেগুলো যাচাই-বাছাই করতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিলম্ব হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়। ক্ষেত্রবিশেষে আসামি বা পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে এবং ভিকটিমকে উদ্ধার না করা গেলে আদালতের অনুমতিসাপেক্ষে তদন্তের সময়সীমা বাড়ানো হয়। তিনি বলেন, সিআইডির মানব পাচার ইউনিট একটা আস্থার জায়গা। এখানে যাঁরা আসেন তাঁদের সর্বাত্মকভাবে প্রতিকার দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ২০২২ সালে ৫০টি মামলা তদন্ত শেষ করা হয়েছে। এই সময়ে গ্রহণ করা হয়েছে আরও ৩০টি মামলা। বর্তমানে আরও ৫৬টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে।

আরও পড়ুন

×