ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

মানব পাচারের নতুন গন্তব্য

কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশিরা ভুয়া কোম্পানির ফাঁদে

কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশিরা ভুয়া কোম্পানির ফাঁদে

প্রতীকী ছবি

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ২০:৪৯

ইসমাইল হোসেন পড়াশোনা করতেন মানিকগঞ্জের সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে। শিবালয়ের মহাদেবপুরে তাঁর কৃষক বাবা আবুল কালামের পাঁচ সদস্যের টানাটানির সংসার। কম্বোডিয়ায় অভিবাসী হয়ে সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে ইসমাইল বোনেন রঙিন স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন ছুঁতে লেখাপড়া শিকেয় তুলে ধারকর্জ করে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর পাড়ি জমান কম্বোডিয়া। দুই মাসও পার হয়নি। তেতো অভিজ্ঞতার দুঃস্বপ্ন ফেরি করে দেশে ফেরেন ১১ নভেম্বর।

ইসমাইল শোনান তাঁর জীবনের কষ্টকথা। তিনি জানান, মাস ফুরালে ৭৫ হাজার টাকা মাইনে, কম্পিউটার অপারেটর পদ। 'জেকে এক্সিলেন্ট' নামে একটি প্রতিষ্ঠানে এমন ভালো চাকরির টোপ ফেলেছিল বাংলাদেশি দালাল মুকুল। কম্বোডিয়ায় পা রাখার পরপরই নেওয়া হয়েছিল রাজধানী নমপেনের একটি হোটেলে। সেখানে তানভীর নামে কম্বোডিয়ায় আরেক দালাল তাঁর পাসপোর্ট নিয়ে নেয়। দু'দিন পর তাঁকে নেওয়া হয় আরেক হোটেলে। সেখানে অভিযান চালায় পুলিশ। পাসপোর্ট দেখাতে না পারায় গ্রেপ্তার করা হয়। যেখানে রাখা হয়েছিল, সেটা ছিল এক ধরনের জেলখানা। কেউ কেউ সেটাকে 'সেফ হাউস' বলে। ২৫ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হয়ে ১১ নভেম্বর দেশে ফেরত আসা পর্যন্ত প্রতিদিন ছিল প্রাণ বাঁচানোর যুদ্ধ। এক পোশাকে ৪৪ দিন কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে রাখা হয়। একই ফুলপ্যান্ট ও জার্সি পরতে পরতে অনেক জায়গায় ছিঁড়ে গিয়েছিল। ঠিকমতো দেওয়া হতো না খাবার। লোক মারফত বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছিল।

ইসমাইলের মতো অনেকেই স্বপ্ন এঁকে কম্বোডিয়া গিয়ে যন্ত্রণা নিয়ে ফিরছেন দেশে। বাংলাদেশ থেকে যেসব অসচ্ছল মানুষ ভালো কর্মসংস্থানের খোঁজে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান- তাঁদের ৫১ শতাংশই পাচার চক্রের খপ্পরে পড়ে। গত বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক আলোচনায় বাংলাদেশ থেকে কোন কোন দেশে সবচেয়ে বেশি মানব পাচার হয়, সে তথ্য উঠে এসেছিল। সেখানে বলা হয়, ভারত, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, থাইল্যান্ড, ইতালি, গ্রিস, পর্তুগাল, সাইপ্রাস, স্পেন, সৌদি আরব, ওমান, কাতার, ইরাক ও লিবিয়ায় বৈধ-অবৈধ উপায়ে যায়। সেখানে ছিল না কম্বোডিয়ার নাম। এখন দেশটি মানব পাচারের নতুন গন্তব্য হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতি মাসে এশিয়ার 'ইউরোপ' হিসেবে পরিচিত দেশটি থেকে প্রতারিত হয়ে ফিরছেন বাংলাদেশিরা। কম্বোডিয়া থেকে ফেরা দুই ভাগ্যহত ব্যক্তি ঢাকায় এসে দুটি আলাদা মামলাও করেছেন। এর একটি মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। আরেকটির তদন্তে নেমেছে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)।

দুর্বিষহ জীবনের মুখোমুখি হয়েছেন এমন একাধিক ভুক্তভোগী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশটিতে ভালো চাকরি দেওয়ার টোপ ফেলে লাখ লাখ টাকা যারা হাতিয়ে নিচ্ছে তাদের অন্যতম আমিনুল খন্দকার। তার নমপেনে আছে বিশাল অফিস। তার দুই সহযোগী শামীম আব্দুল্লাহ ও আবু তাহের। বাংলাদেশ-ভারত থেকে তাদের মাধ্যমে কেউ কম্বোডিয়া গেলে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানানো হয়। আমিনুল মানব পাচারের পাশাপাশি হুন্ডির কারবারেও জড়িত। ভুয়া কোম্পানির নামে নমপেন থেকে ওয়ার্ক অর্ডার পাঠায় সে। এ ছাড়া কম্বোডিয়ায় একই ধরনের ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানের জাল ফেলে প্রতারণা করছে মো. জালাল, নাজমুল, আব্দুল আলিম, শফিক আহম্মেদ, সেলিম রেজা, আলি রেজা ও লায়ন কামাল। আর কম্বোডিয়া অবস্থান করা ওই চক্রের হয়ে বাংলাদেশে যারা কাজ করছে তারা হলো- পিরোজপুরের নাজিরপুরের মাসুদ খান, মাহমুদ খান, বরিশালের জিএম ফেরদৌস, জিয়াউর রহমান, চাঁদপুরের মতলবের জাহাঙ্গীর আলম।

কম্বোডিয়ার জালিয়াতির ঘটনায় করা একটি মামলা তদারক করছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের এডিসি তৌহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, কম্বোডিয়ায় যেসব বাংলাদেশি যাচ্ছেন, তাঁদের অধিকাংশ প্রতারিত হচ্ছেন। নামিদামি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার কথা বলে তাঁদের চায়নিজ প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হয়। ইন্টারপোল ও এনসিবির মাধ্যমে কম্বোডিয়ায় অবস্থান করা কয়েকজনের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। নমপেনের ওই চক্রটির হয়ে ঢাকায় কাজ করা সোহেল নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কম্বোডিয়া লোক পাঠানোর বিনিময়ে প্রতি লাখে ২৫ হাজার টাকা পেত সোহেল।

৪৪ দিনের বন্দিজীবন: প্রতারিত ইসমাইল বলেন, 'গ্রেপ্তার হয়ে ৪৪ দিনের বন্দিজীবনের প্রতি মুহূর্ত যে কষ্টকর ছিল, তা মন থেকে মুছতে পারি না। মনে হতো, এখনই মারা যাব। ২ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করে কম্বোডিয়া যাই। পরে সেখানে পৌঁছার পর দফায় দফায় ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা এনেছি। সব মিলিয়ে ৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ৮০ হাজার টাকা দালালকে দিয়ে পাসপোর্ট উদ্ধার করি।'

তিনি বলেন, 'অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে নমপেনে মাত্র চার দিন মুক্ত ছিলাম। কোনো কাজেও যোগ দেওয়ার সুযোগ পাইনি। কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার আগেই একটি চায়নিজ প্রতিষ্ঠানের কাছে আমাকে ৫ হাজার ডলারে বিক্রি করা হয়েছিল। সেই প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার আগেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ি। এখন ৬ লাখ টাকা ঋণের বোঝা কীভাবে মেটাব, এটা নিয়ে পরিবার উদ্বিগ্ন। প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরলেও ঠিকমতো ঘুম আসে না।'

ফয়সাল বিক্রি হন ধাপে ধাপে: নরসিংদীর পলাশের মো. ফয়সালের অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ। কম্পিউটার ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে মাসে ৬০ হাজার টাকা বেতনে কাজ পাওয়ার আশায় ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি কম্বোডিয়া যান তিনি। 'সাইবার ক্রীতদাস' হিসেবে কয়েকটি কোম্পানির কাছে তাঁকে ধাপে ধাপে বিক্রি করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছদ্মনামে অ্যাকাউন্ট খুলে প্রতারণা, ক্লোন ওয়েবসাইট ব্যবহার করে ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা আত্মসাতের কৌশল শেখানো হয়। পাশাপাশি ঋণ দেওয়ার নাম করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভয়েস কল ও ভিডিও কল রেকর্ড করে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ করার কৌশলও রপ্ত করা হতো। এভাবে তাঁকে ব্যবহার করে মানব পাচারকারী চক্র সাইবার অপরাধের কার্যক্রম চালায়। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁকে দেশে ফেরত আসতে হয়।

ফয়সাল বলেন, কম্বোডিয়ায় ২ হাজারের মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর বেশিরভাগ চায়নিজ নাগরিকরা চালান। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ হলো, সাইবার জগতে প্রতারণার ফাঁদ পাতা। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শত শত নারী সেখানে চাকরি করেন। বিভিন্ন দেশের টার্গেট করা ব্যক্তিদের অডিও এবং ভিডিও কলে যোগাযোগ করে তারা প্রথমে সম্পর্ক তৈরি করে। এর পর ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়।

তিনটি কোম্পানির কাছে বেচাকেনা: খুলনার ডুমুরিয়ার প্রসেনজিতেরও কম্বোডিয়া গিয়ে স্বপ্ন ভেঙেছে। গত ২ জুলাই কম্বোডিয়া যান তিনি। দেশে ফেরেন ২৬ নভেম্বর। পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার হন ২৬ সেপ্টেম্বর। টানা দুই মাস বন্দি ছিলেন। প্রসেনসিৎ জানান, তিনটি কোম্পানির কাছে তাঁকে বিক্রি করা হয়েছিল। প্রথম প্রতিষ্ঠানে ৯ দিন, দ্বিতীয়টিতে পাঁচ দিন কাজ করেছিলেন। তৃতীয় কোম্পানিতে কাজ করার সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। এর পর থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের দূতাবাসে খবর পৌঁছান। শেষ পর্যন্ত একটি এনজিওর মাধ্যমে দেশে ফেরত আসেন। সব মিলিয়ে তাঁর ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। প্রসেনজিৎ বলেন, কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশের দূতাবাস নেই। থাইল্যান্ডের দূতাবাস থেকে কম্বোডিয়ায় প্রবাসীদের যে কোনো সমস্যার বিষয় দেখভাল করা হয়।

রুবেলের পল্টন থানায় মামলা: কম্বোডিয়ায় গিয়ে প্রতারিত হন পিরোজপুরের নাজিপুরের রুবেল শেখ। এ ব্যাপারে ১৪ জানুয়ারি তিনি পল্টন থানায় মামলা করেন। এজাহারে বলা হয়, ৩ লাখ টাকার চুক্তিতে ২০২০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কম্বোডিয়া যান তিনি। সেখানে পৌঁছার পর জাহাঙ্গীর নামে এক ব্যক্তি তাঁর পাসপোর্ট নিয়ে যায়। একইভাবে ২১ বাংলাদেশির পাসপোর্ট জাহাঙ্গীর তার হেফাজতে নেয়। প্রথমে তাঁদের বালু ভরাটের কাজ দেওয়া হয়। সেখানে এক মাস কাজ করলেও বেতন পাননি। শুধু খাবার দেওয়া হতো। জাহাঙ্গীর পরে রুবেল শেখসহ অন্য বাঙালিদের আরেকটি চায়নিজ কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয়। জনপ্রতি ৫ হাজার ডলার পেয়েছিল জাহাঙ্গীর। কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করার কথা ছিল। তবে কম্পিউটারের কাজ না পারায় ওই কোম্পানি জনপ্রতি ৫ হাজার ডলার ফেরত চায়। ডলার ফেরত না দেওয়ায় তাঁদের ওপর নির্যাতন করা হতো। শেষ পর্যন্ত হটলাইনে ফোন করে তাঁরা বিষয়টি কম্বোডিয়ার পুলিশকে জানান। এর পর 'উইনরক ইন্টারন্যাশনাল' নামে একটি এনজিওর সহযোগিতায় দেশে ফেরত আসেন রুবেল।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের ডিসি জসীম উদ্দিন বলেন, 'কম্বোডিয়াকেন্দ্রিক প্রতারক চক্রে যারা সক্রিয়, তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি। বিদেশে চাকরির নামে ফাঁদের ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে।'

আরও পড়ুন

×