ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

এত আইস যায় কোথায়

এত আইস যায় কোথায়

বকুল আহমেদ

প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ২৩:৫৫

ক্রিস্টাল মেথ বা আইস নতুন মাদক হিসেবে বাংলাদেশে আলোচনায় আসে ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারির পর। ওই দিন রাজধানীর ধানমন্ডির জিগাতলায় একটি ল্যাব থেকে জব্দ করা হয় আট গ্রাম আইস। এর পরই নতুন নেশাদ্রব্যটি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

প্রথম দিকে দুষ্প্রাপ্য হলেও বর্তমানে আইস অনেকটাই হাতের নাগালে। এর চাহিদা যে দিন দিন বাড়ছে, তা জব্দের পরিমাণ দেখলেই বোঝা যায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি), পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), র‌্যাব এবং কোস্টগার্ডের ২০২১ সালের অভিযানে আইস জব্দ হয়েছিল ৩৬ কেজি ৭৯৪ গ্রাম। পরের বছর জব্দের পরিমাণ তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে। ২০২২ সালে আইস জব্দ করা হয়েছে ১১৩ কেজি ৩৩১ গ্রাম।

সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, যদি এই পরিমাণ জব্দ হয়, তাহলে অবশ্যই আরও একাধিক চালান পৌঁছে গেছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাতে। তাঁরা জানান, যে কোনো জিনিসের চাহিদা বাড়লে সরবরাহ বাড়ে। আইসের ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। আইস অতি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মাদক। অল্প মাত্রায় সেবন করলে বেশি মাত্রায় আসক্তি হয়। এ কারণে ইয়াবা ছেড়ে এর দিকে ঝুঁকছে মাদকসেবীরা। এ ছাড়া প্রথম দিকে দামও ছিল চড়া। প্রতি কেজি ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা পড়ত। অভিজাত পরিবারের মাদকসেবী সন্তানরাই এটি গ্রহণ করত। বর্তমানে দাম কমে কেজিতে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকায় নেমেছে। প্রতি গ্রামের দাম পড়ছে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। এ কারণে অভিজাত পরিবারের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও এদিকে হাত বাড়াচ্ছে। এতে বেশি চালান আসা শুরু করেছে।

মিয়ানমার থেকে নাফ নদ হয়ে দেশে আইস ঢুকছে। ইয়াবা চালানের সঙ্গে এটি আনা হচ্ছে বলে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। অবশ্য আইসের আলাদা চালানও ঢুকছে। সীমান্ত এলাকা ও দেশের ভেতরে ইয়াবা এবং আইসের রুট প্রায় অভিন্ন। মিয়ানমারের আকিয়াব সীমান্ত হয়ে ফিশিং ট্রলারে নাফ নদ পার হয়ে টেকনাফের হাবিরছড়া ঘাটে পৌঁছানো হয় আইসের চালান। ঘাট থেকে উঠেই একটি গ্রাম। গ্রামটি পার হয়ে পাহাড়। প্রথমে ওই পাহাড়ে আইস লুকিয়ে রাখা হয়। সুযোগ বুঝে পাহাড়ের পাশের জাদিমোড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢোকানো হয়। পরে নানা কৌশলে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম হয়ে সরবরাহ করা হয় ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায়।

কক্সবাজারে ইয়াবার রুটে ২০২০ সালে প্রথম আইসের চালান ধরা পড়ে ডিএনসির টেকনাফ বিশেষ জোনের অভিযানে। ওই সময় দুই কেজি আইসসহ আব্দুল্লাহ নামে এক মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি টেকনাফের মাদক কারবারি রফিকের কাছ থেকে ওই আইস সংগ্রহ করেছিলেন। রফিক সরাসরি মিয়ানমার থেকে আইসের চালানটি এনেছিলেন। অবশ্য পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' রফিক মারা যান।

ডিএনসির কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা সমকালকে বলেন, আইসে মিথাইল অ্যামফিটামিন থাকে ৯৬ শতাংশ, যা ইয়াবার চেয়ে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ বেশি। এ কারণে অল্প মাত্রায় সেবনেও বেশি মাত্রায় আসক্তির সৃষ্টি হয়। এ কারণে ইয়াবার চেয়ে এর চাহিদা বাড়ছে।

তিনি জানান, আইস ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মস্তিস্ক। এটি শরীরের ভারসাম্য ভেঙে ফেলে এবং মস্তিস্ক থেকে বেশি পরিমাণ ডোপামিন নিঃসৃত হয়। এতে মাদক গ্রহণে আসক্তি বেড়ে যায়। বেশি আসক্তির ফলে মস্তিস্কের সূক্ষ্ণ স্নায়ুতন্ত্র ডিসপ্লেস হয়ে যায়। তখন কোনো চিকিৎসায় তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায় না। এ ছাড়া লিভার, কিডনি, দৃষ্টিশক্তি, স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি, শ্রবণশক্তি, চেতনাশক্তি, স্মৃতিশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ডিএনসির ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক জাফরুল্যাহ কাজল বলেন, ইয়াবার নকল বের হয়েছে। আইস এখনও নকল হয়নি। তাই যাদের কেনার সামর্থ্য রয়েছে তারা ইয়াবা ছেড়ে আইসে ঝুঁকছে। অবশ্য মাদকবিরোধী তৎপরতা বাড়ায় জব্দও বেশি হচ্ছে।

এদিকে ২০২২ সালে আইস ছাড়া অন্য মাদক জব্দের হিসাবও দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ওই বছর ইয়াবা জব্দ করা হয় ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫৬৯ পিস। ২০২১ সালের তুলনায় এটি ৭২ লাখ ৫ হাজার ৯৬ পিস বা ১৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ কম। এ ছাড়া হেরোইন ৩৩৮ কেজি ২৭৯ গ্রাম, কোকেন ৪ কেজি ৫৭ গ্রাম, আফিম ৪৬ কেজি ৭৬৩ গ্রাম ও গাঁজা জব্দ করা হয়েছে ২ হাজার ৮৮৪ মণ। ২০২১ সালের তুলনায় গাঁজা উদ্ধার হয়েছে ৭১৭ মণ বা ৩৩ শতাংশ বেশি। ২০২১ সালে ফেনসিডিল জব্দ করা হয়েছিল ৫ লাখ ৭৪ হাজার ৩০১ বোতল ও ১০৬ লিটার। গত বছর তা ২৩ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৭ লাখ ৬ হাজার ৬১ বোতল এবং ২৮৬ লিটার। এ ছাড়া গত বছর মাদকের ১ লাখ ৩২১ নতুন মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৭৭৫ জনকে।

আরও পড়ুন

×