সিটি নির্বাচন
বরিশালের ভোটে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ‘নারায়ণগঞ্জ কৌশল’

রাজীব আহাম্মদ ও সুমন চৌধুরী, বরিশাল থেকে
প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৯ মে ২০২৩ | ২২:৪৯
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ‘নারায়ণগঞ্জ কৌশল’ নিয়েছেন নৌকা প্রার্থী ও তাঁর সমর্থকরা। যদিও এ বিষয়টি স্বীকার করতে চান না মেয়র প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত। নারায়ণগঞ্জে নৌকার মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ভোটের প্রচারে নিজ দলের এমপি শামীম ওসমানের বিরোধিতায় মুখর ছিলেন। ওসমান পরিবারের প্রভাব-প্রতিপত্তির বিরোধী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছিলেন। একই কায়দায় বরিশালে নৌকার মেয়র প্রার্থীর অনুসারী আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেদের হাসানাত পরিবারের বিরোধী হিসেবে তুলে ধরছেন ভোটের মাঠে। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ বিভেদ মেটাতে বললেও হাসানাত পরিবারকে ভোটের প্রচারে চাইছেন না নৌকা প্রার্থীর প্রচারকারীরা।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের ২০১৮ সালের নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ নৌকা প্রতীকে মেয়র পদে একতরফা জয় পান। পরের বছর তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পান। আবুল হাসানাত বঙ্গবন্ধুর ভাগনে এবং পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ছেলে।
স্থানীয় নেতাদের ভাষ্য, বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতি আবুল হাসানাত ও সাদিক আবদুল্লাহর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিন্তু সাদিক আবদুল্লাহ এবারের নির্বাচনে মনোনয়ন না পাওয়ায় নিয়ন্ত্রণের রাশ কিছুটা আলগা হয়েছে। সাদিকের পরিবর্তে তাঁর চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহকে মেয়র প্রার্থী করেছে আওয়ামী লীগ। যিনি খোকন সেরনিয়াবাত নামেই পরিচিত। আবুল হাসানাতের পরিবারের সঙ্গে তাঁর প্রকাশ্য বিরোধ রয়েছে।
তবে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভোটের প্রচারের দায়িত্বে থাকা নেতারা এই বিরোধকে আদর্শিক লড়াই হিসেবে তুলে ধরছেন। লড়াইয়ের আবহ টিকিয়ে রাখতে তাঁরা চান হাসানাত পরিবার ভোটের প্রচারে না থাকুক। রক্তের সম্পর্ক থাকলেও খোকন সেরনিয়াবাত হাসানাত পরিবারের প্রতিনিধি নন– ভোটের মাঠে এই বার্তাই দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
বড় ভাই ও ভাতিজাকে ভোটের প্রচারে খোকন সেরনিয়াবাতও চাইছেন না। যদিও প্রকাশ্যে তিনি এটা বলছেন না। তিনি এ প্রসঙ্গ বারবার এড়িয়ে যাচ্ছেন। সমকালকে বলেছেন, ‘সাংগঠনিক পদে থাকায় নৌকাকে বিজয়ী করা তাঁদের (আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং সাদিক আবদুল্লাহ) দায়িত্ব। দায়িত্ব পালনে বিরত থাকলে, আমার তো কিছু বলার নেই।’
ব্যক্তিগতভাবে চান কিনা তাঁরা প্রচার চালাক– এ প্রশ্নে খোকন সেরনিয়াবাত সমকালকে বলেছেন, ‘আমার ব্যক্তিগত চাওয়া কোনো বিষয় নয়। আমাকে মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। মানুষ যেভাবে রেসপন্স করবে, আমি সেভাবেই ইয়ে (প্রচার) চালাব।’
আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যরা সমকালকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘মানুষ যেভাবে রেসপন্স করবে’-এ কথাতেই স্পষ্ট জনমত সাদিক আবদুল্লাহ বিরোধী; তা ধরে নিয়ে হাসানাত পরিবারকে ভোটের প্রচারে চাইছেন না নৌকার প্রার্থী। এই নেতাদের ভাষ্য, সাদিক আবদুল্লাহ জামানায় সাধারণ নগরবাসী অপদস্থ হয়েছেন। দলীয় রাজনীতি হাসানাত পরিবারের হাতের মুঠোয় চলে গেছে। জেলা ও মহানগর কমিটিতে হাসানাত পরিবারের একান্ত অনুগত হিসেবে পরিচিতরা পদ পেয়েছেন। বাকিরা পদবঞ্চিত। সাদিক আবদুল্লাহ মেয়র হওয়ার পর অনেক নেতা বরিশালে আসতে পারেননি। দলীয় কর্মসূচি দূরে থাক, সামাজিক কর্মসূচিতেও যোগ দিতে পারেননি তাঁরা। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতেই খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষ নিয়েছেন তাঁরা। হাসানাত পরিবারের দাপটে স্থানীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে থাকা বরিশাল-৫ (সিটি করপোরেশন এবং সদর উপজেলা) আসনের এমপি ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম এই বলয়ের নেতা।
বড় ভাই ও ভাতিজার নাম না নিয়ে খোকন সেরনিয়াবাত সমকালকে বলেছেন, আগে যেভাবে রাজনীতি চলছিল, তাতে পরিবর্তন আনতে চান। বরিশালবাসীকে সম্মান দিতে চান। তাঁদের আত্মমর্যাদায় যাতে কেউ আঘাত করতে না পারেন। কেউ যেন আর অপমানিত না হন।
নৌকা প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির নেতাদের ভাষ্য, মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর কর্মকাণ্ডে বরিশাল নগরীতে হাসানাত পরিবার অজনপ্রিয় হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষ নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে। নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণের অভিযোগ তুলে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ সাধারণ মানুষকে ডেকে নিয়ে মোটা অঙ্কের জরিমানা করতেন। নগর ভবনে অফিস করতে চান না। বাসায় গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও অনেকে সাক্ষাৎ করতে পারতেন না। তাঁর অনুগত হিসেবে পরিচিতরাও নানা অপকর্মের অভিযোগে দুষ্ট। এ কারণেই ভোটের প্রচারে হাসানাত পরিবার এবং তাদের অনুসারীদের চাইছে না নৌকা প্রার্থীর সমর্থকরা।
নৌকার নির্বাচনী কমিটিতে থাকা নেতারা বলছেন, তাঁরা প্রচারে নামলে ভোট ও ভাবমূর্তি– দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে রাজনীতির বাইরে থেকে এসে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া খোকন সেরনিয়াবাত হাসানাত পরিবারের প্রতিনিধি বলেই গণ্য হবেন। নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট লস্কর নূরুল হক সমকালকে বলেছেন, ভোটারদের মনোভাব বুঝে প্রচার চালানো গুরুত্বপূর্ণ।
সাদিক আবদুল্লাহ জামানায় মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি থেকে বাদ পড়া নেতা সুভাশীষ ঘোষ বাপ্পি সমকালকে বলেছেন, খোকন সেরনিয়াবাত পরিচ্ছন্ন ও সৎ ভাবমূর্তির মানুষ। তাঁর জন্য কোনো বিতর্কিত লোক ভোট চাইলে নৌকার ভোট কমে যাবে।
গত বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভীরও অভিন্ন কৌশল ছিল। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে শামীম ওসমানকে নৌকার পক্ষে নামালেও আইভী স্পষ্ট করে জানিয়ে ছিলেন যে, ওসমান পরিবারের সমর্থনের প্রয়োজন নেই। তিনি তাঁর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তৈমূর আলম খন্দকারের যতটা না সমালোচনা করেছেন, তার চেয়ে বেশি বিরোধিতা করেছেন ওসমান পরিবারের। বিএনপি নেতা তৈমূর আলমকে বারবার ওসমান পরিবারের প্রার্থী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। আইভীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যদের ভাষ্য ছিল, নারায়ণগঞ্জের ওসমানবিরোধীদের ভোট টানতে এই কৌশল নিয়েছিলেন আইভী। ভোটারদের বারবার সতর্ক করেছিলেন তিনি, পরাজিত হলে ওসমান পরিবারের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে নারায়ণগঞ্জ।
সে একই কৌশল দেখা যাচ্ছে বরিশালে। হাসানাত পরিবারবিরোধী জনমতকে পুঁজি করে ভোট টানার চেষ্টা করছে নৌকা শিবির। এই পক্ষের নেতারাও সতর্ক করছেন, নৌকা হারলে হাসানাত পরিবারের আধিপত্য আরও দৃঢ় হবে। বাকিদের রাজনীতি করা আরও কঠিন হবে।
বরিশালে আওয়ামী লীগের বিরোধ মেটাতে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে ৯ সদস্যের সমন্বয় কমিটি করেছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। পাবর্ত্য শান্তি চুক্তি নিরীক্ষা কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে মন্ত্রী পদমর্যাদায় রয়েছেন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। তিনি বরিশাল-১ আসনের এমপি। তাই ভোটের প্রচারে তিনি অংশ নিতে পারবেন না। মেয়র পদে থাকায় সাদিক আবদুল্লাহও সরাসরি ভোটের প্রচারে নামার সুযোগ নেই। কিন্তু সমর্থন জানাতে বা অনুসারীদের নৌকার প্রচারে নামাতে বাধা নেই। নির্বাচন ও অভিযোগ প্রসঙ্গে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও সাদিক আবদুল্লাহর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তাঁদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
নির্বাচন পরিচালনা কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন সমকালকে বলেছেন, ‘বরিশালের নির্বাচনী কমিটির কেউ বলেননি, তাঁরা নৌকার প্রচারে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও সাদিক আবদুল্লাহকে চান না। আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ সাংগঠনিক টিমের নেতা।’ তিনি ও সাদিক আবদুল্লাহ নামবেন কিনা– এ প্রশ্ন এড়িয়ে আফজাল হোসেন বলেন, ‘এ নিয়ে আলোচনা করতে চাই না।’
খোকন সেরনিয়াবাতের নির্বাচন পরিচালনাকারীরা জানিয়েছেন, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং সাদিক আবদুল্লাহকে তাঁদের পক্ষ থেকে নির্বাচনী প্রচারে ভূমিকা পালনের জন্য এখনও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। গত ১৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালন করে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগ। এতে বরিশালের ৩০টি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা ছিলেন। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং জেলা পরিষদের সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর; যিনি হাসানাত পরিবারের কট্টর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। তিনি সমকালকে বলেছেন, ওয়ার্ড নেতাদের নৌকার পক্ষে নির্বাচন করতে বলা হয়েছে। খোকন সেরনিয়াবাত ঢাকায় গিয়ে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর সঙ্গে দেখা করেছেন। এর পর আর যোগাযোগ হয়েছে কিনা জানা নেই।