গরিবের পুষ্টিতে অনীহা খাদ্য অধিদপ্তরের

অমিতোষ পাল
প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
মুজিববর্ষ উপলক্ষে স্বল্প আয়ের মানুষের পুষ্টি নিশ্চিত করতে দেশের দরিদ্র মানুষের মধ্যে পুষ্টিমিশ্রিত চাল বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। মুজিববর্ষ শেষ হয়ে গেলেও সেই চাল সঠিকভাবে বিতরণ হয়নি। বরং আরও ২১ লাখ ৪০ হাজার পরিবারকে পুষ্টিযুক্ত চাল বিতরণে বাধা তৈরি হয়েছে। সরকার বারবার দরিদ্রদের মাঝে পুষ্টি চাল বিতরণের তাগিদ দিলেও সংশ্লিষ্টদের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। পুষ্টি চাল বিতরণের সেই কার্যক্রম এখন বন্ধ প্রায়।
কার্যক্রমটি বন্ধ থাকায় ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পুষ্টি নিশ্চিত করার যে লক্ষ্য সরকার নির্ধারণ করেছিল, তা ভেস্তে যেতে বসেছে বলে মনে করছেন অনেকে। অভিযোগ উঠেছে, সাধারণ চাল বিতরণের মতো পুষ্টিযুক্ত চাল বিতরণে আর্থিক ফায়দা লোটার সুযোগ না থাকায় উদ্যোগটি ভেস্তে যাচ্ছে। তবে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাখাওয়াত হোসেন সমকালকে বলেন, ‘আগে মানুষের ক্ষুধা দূর করা উচিত, তার পর পুষ্টি। আমরা সে কাজটাই করছি।’ এ বিষয়ে পরিচালক (সরবরাহ ও বণ্টন) তপন কুমার দাস বিস্তারিত জানাতে পারবেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তপন কুমার দাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘পুষ্টি চাল বিতরণে ফায়দা লোটার সুযোগ না থাকায় কার্যক্রমে ধীরগতি বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরকারের পক্ষ থেকে কৃচ্ছ্রসাধনের নির্দেশনা ছিল। এটি তারই অংশ। আবার অর্থায়নকারীদের কাছ থেকে ওই রকম অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে খুব শিগগির কিছু পুষ্টি চাল সংগ্রহ করা হবে।’
পুষ্টি চালের অর্থায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তারা বলছে, খাদ্য অধিদপ্তরের অভিযোগ ঠিক নয়। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান সমকালকে বলেন, ‘নিয়মিত পুষ্টি চাল বিতরণে আমাদের আন্তরিকতায় ঘাটতি নেই। বাজেট কাটছাঁটও করা হয়নি। গরিব মানুষের পুষ্টি নিশ্চিত করতে তারা (খাদ্য অধিদপ্তর) যখন যা চাচ্ছে, আমরা তাই করছি। এর পরও কেন ঠিকমতো সরবরাহ করছে না বুঝতে পারছি না!’
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসমাইল হোসেন এনডিসির সঙ্গে। তিনি সমকালকে বলেন, ‘খাদ্য অধিদপ্তরকে অনেকবার পুষ্টি চাল সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে। কেন তারা ঢিলেমি করছে, বুঝতে পারছি না! হয়তো করে ফেলবে। অবশ্য করোনার সময় অর্থায়নে কিছু সমস্যা হয়েছিল। এখন তো করোনা নেই।’
নির্দেশনা মানে না খাদ্য অধিদপ্তর
পুষ্টি চাল তৈরির জন্য ২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর ৬৪০ টন কার্নেল (ছয়টি ভিটামিনসমৃদ্ধ চালসদৃশ দানা) সংগ্রহ করতে খাদ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। খাদ্য অধিদপ্তর সেই কার্নেল কিনতে এখন পর্যন্ত আগ্রহ দেখায়নি। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ চিঠি দিয়ে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলে। এর পর গত ১৬ মে আরও ৩ হাজার ৩০ টন কার্নেল কেনার জন্য খাদ্য অধিদপ্তরকে তাগিদ দেয় মন্ত্রণালয়। সেই কার্নেল সংগ্রহেও উদ্যোগ নেয়নি অধিদপ্তর। এর আগে খাদ্য মন্ত্রণালয় তাগিদ দেওয়ার পর ১৫৫ উপজেলার কার্ডধারীদের মধ্যে বিতরণের জন্য পুষ্টি চাল সংগ্রহের দরপত্র আহ্বান করে খাদ্য অধিদপ্তর। ওই দরপত্র এখন পর্যন্ত খোলা হয়নি। ২০২২ সালে ওই সব উপজেলার কার্ডধারীরা পাঁচ মাস পুষ্টি চাল পাওয়ার কথা থাকলেও পেয়েছেন মাত্র এক মাস।
কেন পুষ্টি চাল বিতরণ প্রকল্প
আর্থিক অনটনের কারণে দেশের দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষের একটি বড় অংশ পুষ্টিহীনতায় ভোগে। এর ফলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। ত্রুটি নিয়ে অনেক শিশু ভূমিষ্ঠ হয়। ওই সব মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ, পুষ্টিহীনতা দূর এবং মেধাবী ও সুস্থ-সবল ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে শুরু হয় পুষ্টি চাল বিতরণ কার্যক্রম। এতে কারিগরি ও আর্থিক সুবিধা দেয় জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি। পরে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ কার্যক্রমে যুক্ত হয়।
এই মন্ত্রণালয়ের ‘ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট’ (ভিডব্লিউবি) প্রকল্পের আওতায় দেশের ১৭১টি উপজেলার ৪০ হাজার অসচ্ছল পরিবার প্রতি মাসে বিনামূল্যে ৩০ কেজি ৩০০ গ্রাম করে পুষ্টি চাল পেতে শুরু করে। ইউপি চেয়ারম্যানের মাধ্যমে এই চাল বিতরণ হয়। পাশাপাশি জাতিসংঘের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির (ফুড ফ্রেন্ডলি প্রোগ্রাম- এফএফপি) আওতায় ২৫১টি উপজেলার ২১ লাখ পরিবার বছরে পাঁচ মাস সমপরিমাণ পুষ্টি চাল পাওয়ার কথা। প্রতি কেজি চালের দাম দিতে হবে ১৫ টাকা। সরকারের তালিকাভুক্ত ডিলাররা তাদের কাছে পুষ্টি চাল বিক্রি করবেন। কর্মসংস্থানের ঘাটতির পাঁচ মাস, অর্থাৎ মার্চ, এপ্রিল, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরে তাদের ওই চাল দেওয়ার পরিকল্পনা। দাতা সংস্থা ও সরকারের বরাদ্দে ঘাটতি না থাকলেও গত দু’বছর দরিদ্ররা এই চাল ঠিকমতো পাননি। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে পুষ্টি চাল দিতে পারেনি খাদ্য অধিদপ্তর। ২০২৩ সালের এপ্রিলে পুষ্টি চাল সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। এ ছাড়া মুজিববর্ষ উপলক্ষে এই কার্যক্রম জোরদার করার অংশ হিসেবে ১০০ উপজেলার ৪০ লাখ পরিবারের মধ্যে পুষ্টি চাল বিতরণের নির্দেশ ছিল, অথচ পাঁচ মাসের পরিবর্তে চাল বিতরণ হয় মাত্র দুই মাস।
পুষ্টি চাল কী
১০০টি সাধারণ চালের মধ্যে ছয়টি ভিটামিনসমৃদ্ধ একটি কার্নেল (১০০:১) মিশিয়ে পুষ্টি চাল তৈরি করা হয়। কার্নেলে থাকে ভিটামিন এ, বি, বি-১২, আয়রন, ফলিক এসিড ও জিঙ্ক। এসব ভিটামিনের অভাবে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় ও নানা ধরনের রোগ হয়। নানা ত্রুটি নিয়ে শিশুর জন্ম হয়। সরকারের তালিকাভুক্ত ৭৫টি মিলারের মাধ্যমে সাধারণ চলের সঙ্গে কার্নেল মিশিয়ে পুষ্টি চালের ৩০ কেজি ৩০০ গ্রামের একেকটি বস্তা তৈরি করা হয়। মিলাররা বস্তাগুলো সরাসরি নির্ধারিত ইউপি চেয়ারম্যান ও ডিলারদের কাছে পাঠিয়ে দেন।
সাধারণ চাল বিতরণে কী মধু
পুষ্টি চালের পরিবর্তে খাদ্য অধিদপ্তর সাধারণ চাল বিতরণে বেশি আগ্রহী বলে মনে করেন কেউ কেউ। কারণ, গুদাম থেকে সাধারণ চালের যে বস্তা দেওয়া হয়, তাতে খাদ্য অধিদপ্তর ছাড়া কিছুই লেখা থাকে না। এই চাল ডিলাররা ১৫ টাকা কেজি দরে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিক্রি করেন। তাছাড়া, বস্তায় কখনোই ৩০ কেজি চাল থাকে না। তাতে ডিলাররাও আপত্তি করেন না। অভিযোগ রয়েছে, বস্তায় চাল কম দেওয়ার সঙ্গে শুধু গুদাম কর্মকর্তা নন, উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা থেকে শুরু করে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ও সহকারী মহাপরিচালকরাও (এডিজি) জড়িত।
পুষ্টি চালে এই সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, মিলাররা চাল ও কার্নেল শতভাগ বুঝে নেন। আবার কার্নেল মিশ্রিত চাল ঠিকমতো বুঝিয়েও দেন। রাজধানীর মহাখালীর ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবে সেই চাল পরীক্ষা হয়। পুষ্টি চালের বস্তার গায়ে প্রকল্পের নাম, মিলারদের নাম-ঠিকানা, চালের পরিমাণ, বাংলাদেশ সরকারের লোগো, বিক্রর জন্য নয়, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, কোন এলাকার মানুষের জন্য তৈরি ইত্যাদি বিস্তারিত লেখা থাকে। ফলে এই চাল ডিলার ও ইউপি চেয়ারম্যানের পক্ষে বাজারে বিক্রি করা কঠিন। তাছাড়া, পুষ্টি চালের রং কিছুটা ভিন্ন। তাই সাধারণ ক্রেতারা তা কিনতে চান না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে খাদ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, পুষ্টি চাল কর্মসূচি জোরদারে ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নারায়ণগঞ্জের সিএসডিতে একটি কার্নেল ফ্যাক্টরি স্থাপন করা হয়েছে কয়েক বছর আগে। খাদ্য অধিদপ্তরের অনীহার কারণে সেখানে এখনও উৎপাদন শুরু হয়নি।
এ প্রসঙ্গে তপন কুমার দাস বলেন, ‘কার্নেল ফ্যাক্টরিটি গত এপ্রিলে উদ্বোধনের কথা ছিল। কাজ শেষের দিকে।’ তিনি বলেন, ‘পুষ্টি খেলেই যে রাতারাতি সবাই রোগমুক্ত হয়ে যাবে, এমনটা না। বরং এখন চিন্তা করা হচ্ছে, পুষ্টি চাল দিতে যে টাকা খরচ হয়, ওই টাকা সরাসরি গরিবদের দিলে তারা অনেক শাকসবজি কিনে খেলে বেশি পুষ্টি পাবে।’