ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী

ঝুঁকিপূর্ণ ভবন এখনই চিহ্নিত করতে হবে

ঝুঁকিপূর্ণ ভবন এখনই চিহ্নিত করতে হবে

--

প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০

এক সময় ভূমিকম্পের বেশির ভাগ কেন্দ্রস্থল ছিল সিলেট ও চট্টগ্রামে। সাম্প্রতিক সময়ে এর কেন্দ্র হয়ে উঠছে ঢাকার আশপাশ এলাকা। গত মে মাসে ঢাকার দোহারে ৪ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্পের পর গতকাল টাঙ্গাইলে উৎপন্ন ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ২। এ নিয়ে গত এক যুগে ঢাকার আশপাশে ৯টি ভূমিকম্প হয়েছে। ঢাকার পাশে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ কতটা ঝুঁকিপূর্ণ; দেশে এর প্রবণতা, মোকাবিলা ও পরবর্তী করণীয় নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারীর সঙ্গে কথা বলেছেন জাহিদুর রহমান।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মেহেদী আহমেদ আনসারী দোহার ও টাঙ্গাইলের ভূমিকম্পকে দেখছেন বড় ভূমিকম্পের লক্ষণ হিসেবে। এ জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ঢাকার কাছাকাছি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল অস্বাভাবিক বলা যাবে না। এর আগেও হয়েছে। বড় একটা ভূমিকম্প আসার কয়েক বছর আগে থেকে ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়। ছোট ভূমিকম্পগুলো বড় ভূমিকম্প যেখানে হবে, সেখানে না হয়ে অন্য জায়গা বা তার আশপাশে হয়। তুরস্কের বড় ভূমিকম্পের আগে ১০০টিরও বেশি ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়েছিল। গত এক বছরে বাংলাদেশে ৫০টিরও বেশি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ছোট এসব কম্পন শক্তি সঞ্চয় করছে। ফলে সামনে বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা আছে।

মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ঢাকা থেকে ফল্ট জোন ১০০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে। ফল্ট জোন টাঙ্গাইলের মধুপুর ও সিলেটে আছে। যেভাবে দেশে ভূমিকম্প বাড়ছে, তাতে ঢাকার আশপাশে যে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা আছে– তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। ১৮৮৫ সালে মধুপুরে ভূমিকম্প হয়েছে। গত ১০০ বছরের মধ্যে দেশে তেমন বড় ভূমিকম্প হয়নি; এটা এক আশঙ্কার বিষয়। কারণ, একটি বড় ভূমিকম্পের ১০০ থেকে ১৫০ বছর পর আরেকটি বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা থাকে। ফলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের একটা আশঙ্কার মধ্যে আছি আমরা। সব উৎসই ঢাকার আশপাশে। ফলে ঢাকার ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে ভূমিকম্প হলে ঢাকায় কিছুই থাকবে না।

তিনি বলেন, ১৮৬৯ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত আমাদের এ অঞ্চলে পাঁচটি বড় ভূমিকম্প হয়েছে। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্প সবচেয়ে বড় ছিল। এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৭। এক তথ্যে জানা যায়, ঢাকায় তখন ১০০ পাকা ভবন ছিল, জনসংখ্যা ছিল ৯০ হাজার। আয়তন ছিল ২০ বর্গকিলোমিটার। এখন ঢাকার লোকসংখ্যা প্রায় ২ কোটি। রাজউকের হিসাবমতে, আয়তন ১৫২৮ বর্গকিলোমিটার। ভবন প্রায় ২১ লাখ। চারতলার ওপরের ভবন ছয় লাখ। ধসে পড়ার ঝুঁকিতে আছে ৯ লাখ ভবন। মধুপুর চ্যুতিরেখায় ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় মারা যেতে পারেন ২ লাখ ১০ হাজার মানুষ।

বড় বিপর্যয়ের আগে সবাইকে দ্রুত সাবধান হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এ গবেষক বলেন, রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও শুধু ভবনধস নয়; ঢাকার অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও গ্যাসলাইন এ নগরকে একটি অগ্নিকূপে পরিণত করতে পারে। ঢাকা শহরকে ভূমিকম্প-সহনশীল করে গড়ে তোলার কাজে দেরি করা যাবে না। আমরা বুয়েটের পক্ষ থেকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা ভবনগুলোকে লাল; মাঝারি ঝুঁকিতে থাকা ভবনগুলোকে হলুদ ও ভূমিকম্প-সহনশীল ভবনকে সবুজ রং দিয়ে চিহ্নিত করার কথা বলেছিলাম। কিন্তু রাজউক এটা এখনও বাস্তবায়ন করছে না। তারা শুধু ৩ হাজার ৫০০টি স্কুল চিহ্নিত করেছে। তাদের অনেক কাজ, কিন্তু তা করে না। যা করার, ভূমিকম্পের আগেই করতে হবে; এখনই করতে হবে। ভূমিকম্প সামাল দেওয়ার সক্ষমতা আমাদের নেই। এক রানা প্লাজা থেকে মানুষকে উদ্ধার করতে আমরা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম।

ঢাকার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা কোনটি– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, মাটির দিক থেকে ঢাকায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা জলাশয়-খালবিল ভরাট করে যেখানে ভবন উঠেছে। রাজউক নিজেই ডোবা-নালা ভরাট করে ভবন করেছে। উত্তরা ও পূর্বাচলে অনেক অংশের জলাশয় ভরাট করে ভবন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আর ভবনের দিক থেকে পুরান ঢাকা ঝুঁকিপূর্ণ। এদিক থেকে নতুন ঢাকার ভবন মজবুত।

বিবিসির এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, তুরস্কে একজন মানুষকে উদ্ধারের পেছনে প্রায় ২ কোটি টাকার সমান অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। ভারতের গুজরাটের ভূমিকম্প থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। এর পরই বুয়েটে ভূমিকম্প ইনস্টিটিউট করি। প্রতিবছর প্রায় দেড় হাজার প্রকৌশলী ও স্থপতি তৈরি হন। ভবন নির্মাণবিধির ওপর প্রকৌশলীদের তিন মাসব্যাপী; স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদদের তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশে ৪০ থেকে ৫০টি কোম্পানির ভবন তদারকের ভালো সক্ষমতা রয়েছে। তাদের দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।

তিনি বলেন, রাজউকসহ চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী ডেভেলপমেন্ট অথরিটি এবং সিটি করপোরেশন ভবনের অনুমোদন দেয়। কিন্তু দেশে প্রায় ৫০টি ভালো প্রতিষ্ঠান আছে, যারা শুধু ভবন নির্মাণের কাজ করে থাকে। তাদের দক্ষতা অনেক বেশি। ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ভবন তদারকের কাজ করছে। আমাদের দেশেও এটা করতে হবে। সারাদেশে বড় বড় শহরে সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে সেখানকার বাসাবাড়ি ভূমিকম্প-সহনীয় কিনা, সেটা যাচাই করতে হবে। এটা করা খুবই জরুরি। কোনো বাসা খারাপ থাকলে মজবুত করার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, ভূমিকম্পে ৯০ শতাংশ মানুষ মারা যায় ভবনধসে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ভূমিকম্প ও ভবন নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছিল। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী। এ বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অবস্থান দুটি বিপজ্জনক চ্যুতিরেখার ওপর। একটি ঢাকা মহানগরের সবচেয়ে কাছে টাঙ্গাইলের মধুপুর চ্যুতিরেখা, অন্যটি সিলেট অঞ্চলের ডাউকি চ্যুতিরেখা। সমীক্ষা করা হয়েছে রাজনীতিবিদদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য, যাতে তারা ভূমিকম্পের ভয়াবহতা ও গুরুত্বটা বুঝতে পারেন এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা নেন।

ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় একটি নতুন ইনস্টিটিউট করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, নতুন সংস্থা গঠন বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে নীতিগত সিদ্ধান্ত হলেও তা থেমে আছে। রাজউক এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ফাইল ছাড় দেয়নি। ভূমিকম্পবিষয়ক নতুন সংস্থাটি তৈরি হলে এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে শুরু করে প্রতিরোধী ব্যবস্থা কিংবা প্রশিক্ষণ; সবকিছুই ওই সংস্থাটি দেখভাল করবে। ফলে সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। তবে এটিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।

আরও পড়ুন

×