অনন্তযাত্রায় আসাদ চৌধুরী

হামিম কামাল
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০
মানুষের মৃত্যু হলে তার সঙ্গে অনেক অলিখিত দিন আর রাতও অন্তর্হিত হয়ে যায়। ইতিহাসের কিছু অধ্যায় আর কোনোদিন মুখ খোলে না। মানুষের মাঝে যারা শিল্পী, তারা মহানিয়মের আলো বয়ে এনেছিলেন। সেই আলো প্রতিভা হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল এবং আমাদের গাঢ় নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছিল তার ওপর। শিল্পীর মৃত্যুতে সেই আলো নিভে যায়। তখন কিছুকাল আমাদের মাঝে মৌলিক অন্ধকার নেমে আসে। কবি আসাদ চৌধুরীর মৃত্যুতে আমরা সেই মৌলিক অন্ধকারে নিমজ্জিত।
আরোগ্যের জন্যও তো ন্যূনতম কিছু শক্তি চাই। কর্কট রোগের মতো কঠিনতম রোগে কবি এমন এক সময়ে আক্রান্ত হলেন, যখন তাঁর দেহের জয়কাল শেষের পথে; প্রাণশক্তির শেষভাগ উপস্থিত। এ রোগের চিকিৎসা ছিল না, তা নয়। রোগের উৎসও নির্ণয় করা গিয়েছিল। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করে তাঁর জন্য আরোগ্যের পথ হয়তো তৈরি করা যেত, কিন্তু বয়সের কারণে তা সম্ভব হয়নি। আসলে শরীর মনের কাছে কি কথা দিয়েছিল, সে অক্ষয় থাকবে? এটা তো জানা সত্য– শরীর ক্ষয়শীল। এবং বেঁচে থাকে মৃত্যুর শর্তে। আর মৃত্যুকে গ্রহণ করে জীবনের স্বার্থে। শর্ত আর স্বার্থের এই হিসাব যতই সরল হোক, ভালোবাসার মানুষেরা তা কখনও মানবে না। আমরা মানতে পারছি না।
আসাদ চৌধুরী ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া গ্রামে। ২০২৩ সালের সমকাল ঈদ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল তাঁর কবিতা ‘যেতে যদি চান উলানিয়া’। ‘যেতে যদি সাধ হয় উলানিয়া/ যান তবে কানে কিছু তুলানিয়া/ খানদানি চাল নেই/ তলোয়ার ঢাল নেই/ রাস্তায় পুল নেই/ মালঞ্চে ফুল নেই/ উলানিয়া তবু মন ভুলানিয়া …’ স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকপ্রিয়তায় হাওয়া দিয়ে লেখা শিথিল কবিতা। যেখানে আমার সত্যিকার প্রেম, তাকেই তো এমন খোলামেলা রাখি। খানদানি চাল উলানিয়ার ছিল এককালে। কিন্তু আসাদ চৌধুরীর সরস মানসে কখনও তা স্থান পায়নি। একটা সহজ সুন্দর আহ্বান ছিল তাঁর হাসিতে, কথায়। বরিশালে জীবনানন্দ মেলা, ঢাকার জাদুঘরে সাহিত্যসভা– সর্বত্র তাঁকে অনুজদের কাছে আসতে দিয়েছেন। তরুণদের বই হাতে নিয়ে এমন যত্নে আর ক’জন পাতা ওল্টাতেন?
উলানিয়া তাঁকে ডাকছিল। জামাতা মোহাম্মদ নাদিম ইকবালের কাছে শুনেছি, কবি বারবার দেশে আসতে চেয়েছেন, কিন্তু পারেননি। পৃথিবীর আরেক প্রান্ত থেকে, বাতাসে ঢেউয়ে ঢেউ হয়ে সবচেয়ে সহজে আসার পথটিও তাঁর রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। শরীর এতটা স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছিল। শুধু যে ব্লাড ক্যান্সার ছিল তাঁর, তা তো নয়। তাঁর বৃক্ক, হৃৎপিণ্ড– সমস্ত কিছুই তাঁর বার্ধক্য জানান দিচ্ছিল বারবার। আপনজনেরা চেয়েছেন কবি দেখিয়ে আনতে, কিন্তু তাঁদের হৃদয়ে তো তখনও আশা জেগে আছে– যদি কবি বাঁচেন! কোনোভাবেই তারা তাঁর চিকিৎসায় কোনো ব্যত্যয় ঘটুক, তা চাননি।
ওশোয়া অঞ্চলের লেকরিজ হেলথের চিকিৎসকরাও প্রশংসনীয় চেষ্টা করেছিলেন তাঁকে বাচাতে। তিনি যে কেবল বাংলা ভাষার কবি, বাঙালির সম্পদ; তা তো নন। তিনি মানুষের বুদ্ধিমত্তার সুন্দরতম প্রকাশ ভাষার শিল্পী। এই শিল্পীকে আমরা তাঁর ভাষার মানুষেরা কতটা শ্রদ্ধা আর দরদে জীবদ্দশায় রাখতে পেরেছি? যদি পুরস্কার হয় এসবের মাপকাঠি, তবে পরিসংখ্যান হয়তো পক্ষেই কথা বলবে। ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ২০১৩ সালের একুশে পদক। কিন্তু মন তো এই পরিসংখ্যানকে সত্য মানে না। ‘কবিতায় নেই, সঙ্গীতে নেই/ রমণীর চারু ভঙ্গিতে নেই/ পাগলের গাঢ় প্রলাপেও নেই/ নাটকের কোন সংলাপে নেই/ শাসনেও নেই, ভাষণে নেই/ আঁধারেও নেই, আলোতেও নেই/ রেখাতেও নেই, লেখাতেও নেই,/ ...কোথায় গেলেন সত্য?’ [সত্য ফেরারী] দেশের উন্মেষকালের অগ্নিসাক্ষী এ কবি এমন এক সময় যাপন করে গেছেন; নতুনতর যুগসন্ধিক্ষণ, যখন ভাষার সৌন্দর্য, সৎসাহিত্য ক্রমশ মর্যাদাহীন হয়ে উঠছে। যখন গড় মানুষের মানবিক উচ্চতার এতটাই দীনতা যে, প্রতিভাবানরা বাঁচার স্বার্থে প্রতিভা ছেঁটে ফেলছে। ‘কবি কি দেখছেন প্রমিত বাংলার/ করুণ হালচাল? ভাষণে, সংলাপে/ সিনেমা, থিয়েটারে ছোট্ট পর্দার/ যাদুর বাক্সতে এ কোন বাংলার/ মাতম ছড়াছড়ি?’ [প্রথম কবি তুমি, প্রথম বিদ্রোহী] কবির মন নিশ্চয়ই কাঁদত। কবিমন তো।
তাঁকে যখন নিজ প্রতিভা খাটো করতে হয়নি, সেই সময়ে তাঁর উপহারগুলো আমাদের হৃদয়ে যত্নে রাখা। ‘তবক দেওয়া পান’ (১৯৭৫), ‘বিত্ত নাই বেসাত নাই’ (১৯৭৬); ‘প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড়’ (১৯৭৬); ‘জলের মধ্যে লেখাজোখা’ (১৯৮২), ‘যে পারে পারুক’ (১৯৮৩); ‘মধ্য মাঠ থেকে’ (১৯৮৪), ‘দুঃখীরা গল্প করে’ (১৯৮৭), ‘বৃন্তির সংবাদে আমি কেউ নই’ (১৯৯৮), ‘কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি’ (২০০৩), ‘ঘরে ফেরা সোজা নয়’ (২০০৬)। শিশুদের হাতে এসেছিল ‘রাজার নতুন জামা’ (ভাষান্তর, ১৯৭৯), ‘ছোট্ট রাজপুত্র’ (ভাষান্তর: ১৯৮২), ‘মিকালেঞ্জেনো’ (জীবনী, ২০০১), ‘সোনার খড়ম’ (২০০৬)। গত বছরের শীতে যখন তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা, জাতীয় জাদুঘরে, কাছে গিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করেছিলাম। কবি নিরুত্তর ছিলেন। চোখ দুটো ছিল ভেজা। শেষ স্বদেশ দেখার বার্তা তাঁর কাছে তখনই পৌঁছে গিয়েছিল কিনা, জানি না। মানুষের জীবনে পাওয়া সবচেয়ে বড় প্রাকৃত শক্তি হলো– তার অনুভব ক্ষমতা ব্রহ্মাণ্ডতুল্য। আর সবচেয়ে বড় প্রাকৃত দুর্বলতা– তার আয়ু শিশিরতুল্য। কবি নিজেকে অনেকের হয়ে ব্যক্ত করেন। আসাদ চৌধুরীও তাঁর ছান্দসিকতায় অনেক ভাষাহীনকে ভাষা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন– ‘প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল/ বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম/ আমাদের নারীদের কথা বলি শোনো..’ [রিপোর্ট ১৯৭১]
লিখেছেন– ‘আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে বারবারা।/ তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়-/ বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো/ ওটা একটা জল্লাদের ছবি/ ...সাত কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ফুলকে সে বুট জুতোয়/ থেঁতলে দেয়…’ [বারাবারা বিডলারকে]
যে স্বদেশ তাঁকে সমস্ত বোঝাপড়ার সূত্র দিয়েছিল, নিজেকে জানার চাবি ও আবহ দিয়েছিল, সেই স্বদেশকে তিনি দিয়েছেন ভাষার বৈভব। সেই বৈভব থেকে প্রবাহিত শক্তি জনস্রোতে মিশে যেত। মৃত্যুর পরও তাঁর দেওয়া ভাষার শক্তির সে প্রবাহ বন্ধ থাকবে না। এই সংগ্রামশীল জাতি তাঁকে মনে রাখবে।
- বিষয় :
- অনন্তযাত্রায় আসাদ চৌধুরী
- আসাদ চৌধুরী