নারীর ক্ষমতায়নে জরুরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা

নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন শীর্ষক মতবিনিময় সভায় আমন্ত্রিত অতিথিরা। সোমবার সমকাল কার্যালয়ে - সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২৩ | ০৮:৫৯
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর নির্দেশনা অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারীকে রাখতে হবে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরের বেশি সময় পরও রাজনৈতিক দলের কমিটিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়েনি। প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার এবং দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধানরা নারী হলেও দলের মূল কমিটি ও তৃণমূলে নারীর অংশগ্রহণ অপ্রতুল। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়লেও তাদের জন্য বরাদ্দ বাড়েনি। নারীর ক্ষমতায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব আছে। এ ক্ষেত্রে নারীদেরও নিজেদের অধিকার আদায়ে এগিয়ে আসতে হবে।
সভায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, নারীরা আজকে শিক্ষাসহ সর্বক্ষেত্রে এগিয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক কমিটির পদায়নে নারীদের খুঁজে পাওয়া যায় না। কমিটি গঠনের আগে কয়েকবার করে কমিটি ফেরত দিয়েও নারী পাওয়া যায় না। বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদেও একজন নারী সদস্য সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হচ্ছেন। এতে নারীর ক্ষমতায়নের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু জামায়াতের মতো ধর্মান্ধ দলের সঙ্গে রাজনীতি করে নারীদের এগিয়ে নেওয়া যাবে না। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নত না হলে নারীর মুক্তি হবে না।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক সংসদ সদস্য হারুন অর রশিদ বলেন, নারী শিক্ষা-চিকিৎসাসহ সর্বক্ষেত্রে অনেক উন্নতি করেছে। তবে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ প্রত্যাশামতো বাড়েনি। আইন করে নারীদের রাজনীতিতে পদায়ন করা যাবে না। রাজনীতি ও ক্ষমতায়নে নারীদের কাজের মাধ্যমেই এগিয়ে আসতে হবে।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, নারী সব কাজের জন্যই যোগ্য– তারা সেটি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। কিন্তু তৃণমূল ও জাতীয় পর্যায়ের সংরক্ষিত আসনের নারী জনপ্রতিনিধিরা কাজের জন্য কোনো বরাদ্দ পান না। ফলে তারা আর রাজনৈতিক জীবনে আগাতে পারেন না। আমাদের সংসদ সদস্যদের বরাদ্দ থেকে নারীদের উন্নয়নে একটা অংশ রাখতে হবে, যাতে তারা কাজ করতে পারেন। এটা না হলে নারী নেতৃত্বের উন্নয়ন হবে না। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য নিলোফার চৌধুরী মনি বলেন, রাজনীতিতে নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করলেও কমিটিতে পদে ও নির্বাচনের মনোনয়নে পুরুষকে এগিয়ে রাখা হয়। ডান-বাম সবখানে নারী অবহেলিত। আমাদের নারীদের এ সংরক্ষিত আসনের নির্বাচন থেকে বের হয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক দলের নেতারা নারীর ক্ষমতায়ন পছন্দ করেন না। কিন্তু যখন তাঁর ঘরে কোনো পুরুষ থাকেন না, তখন তাঁর স্ত্রী বা মাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করান। এখানে রাজনৈতিক দলের নেতা যোগ্য নারীকে বেছে না নিয়ে ঘরের মধ্যে ক্ষমতা ধরে রাখতে চান। তিনি বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে ধর্মান্ধতা প্রধান বাধা নয়। আমি কাজ করতে গিয়ে সবার আগে এলাকার মুরব্বি ও আলেমদের পাশে পেয়েছি। এখানে সবচেয়ে বেশি বাধা হিসেবে কাজ করেছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, দেশের রপ্তানি আয়ের অন্যতম গার্মেন্টশিল্প নারীদের পরিশ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে। কিন্তু আমরা রাজনীতি এবং সংসদে নারীদের তেমন অংশগ্রহণ দেখি না। আন্তর্জাতিক সনদে নারীদের সমান অধিকার নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কথা বলে না। কারণ, এটা বাস্তবায়ন হলে নারীরা উত্তরাধিকার থেকে সবকিছুতে সমান সমান অধিকার লাভ করবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য মাকসুদা আক্তার লাইলি বলেন, ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইনের কারণে নারী-পুরুষের অধিকার আদায়ে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। শিশুরা এ বৈষম্য নিয়ে বড় হয়; পরবর্তী সময়ে শিক্ষা মাধ্যম ধর্মীয় শিক্ষার কারণে তারা একই শিক্ষা গ্রহণ করে। রাজনৈতিক দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা এখনও মনে করেন, নারীরা সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। কিন্তু নারীরা অনেক দূর এগিয়েছেন। এখন সময়ের দাবি, সংরক্ষিত আসনে নারীদের জন্য সরাসরি নির্বাচন করা।
স্বাগত বক্তব্যে সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে কোনো নীতিগত বাধা নেই। কিন্তু বাস্তবে নারীরা বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। তৃণমূল পর্যায়ে ইউনিয়ন, উপজেলা ও পৌরসভায় তারা কাজ করতে পারছেন না। কাজ করতে গেলেই তারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন; অসম্মানিত ও অপদস্থ হচ্ছেন।
শুভেচ্ছা বক্তব্যে অপরাজিতা জাতীয় নেটওয়ার্কের সহ-আহ্বায়ক রোখসানা খন্দকার বলেন, ২০১১ সাল থেকে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে অপরাজিতা কাজ করছে। তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত নারীর ক্ষমতায়নের জন্য লড়াই করছে। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ে নারীদের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ এখনও কাগজে-কলমে। ২০২৩ সালে এসেও এটি বাস্তবে রূপ নেয়নি।
অপরাজিতা জাতীয় নেটওয়ার্কের সহ-আহ্বায়ক সংসদ সদস্য আরমা দত্ত বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে ধর্মান্ধতা নয়, পুরুষই বাধা। আরাফাতের ময়দানে বিদায় হজের ভাষণে মহানবী (সা.) নারীর মর্যাদা দিয়ে গেছেন। আবার হিন্দুদের দেবী দুর্গাকে বলা হয় দশভুজা। অর্থাৎ নারী সব কাজ পারে। নারীর ক্ষমতায়নে রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও সদিচ্ছা নিয়ে কাজ করতে হবে।