সবাইকে ‘খুশি’ করেই জাটকা মারার মচ্ছব

.
সুমন চৌধুরী, বরিশাল কামাল উদ্দিন, কুমিল্লা সোহাগ খান সুজন, শরীয়তপুর
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০০:৫২ | আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০৮:৫২
১০ ইঞ্চি বা ২৫ সেন্টিমিটারের কম আকারের ইলিশের পোশাকি নাম ‘জাটকা’। এ অবয়বের ইলিশ আহরণ, পরিবহন ও বিক্রি পুরোপুরি নিষিদ্ধ। নিষেধাজ্ঞা ভাঙলেই জেল-জরিমানা। তার পরও সরকারের নিষেধাজ্ঞা মানতে যেন বয়েই গেছে! এখন জাটকা কেনাবেচা হয় না এমন মাছের বাজার খুঁজে পাওয়া মুশকিল। নদীতে আহরণ, দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় সরবরাহ, মোকামের আড়তঘরে পাইকারি বিক্রি এবং খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো– চলছে সর্বসমক্ষে। আইনবিরোধী এ কর্ম প্রতিরোধে প্রান্তিক পর্যায়ে জলে-স্থলে ‘সজাগ’ মৎস্য অধিদপ্তর, নৌ পুলিশ ও কোস্টগার্ড। তবু জাটকা নিধন, পরিবহন ও বিপণন সবকিছুই যেন বল্গাহীন। কেন হচ্ছে, কীভাবে চলছে– সেটা খোঁজার চেষ্টা করেছে সমকাল।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, প্রশাসনের প্রতিটি ধাপে ‘খুশি করে’ জাটকা ধরার যেন এক উৎসবই চলছে মেঘনাসহ আশপাশের নদনদীতে। এর পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের প্রশ্রয়ে প্রভাবশালী চক্র। এমন দুই নম্বরি ব্যবসায় তারা বড় লগ্নি করে তুলে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। অপকীর্তি দেখেও মুখে কুলুপ লাগানোদের তালিকায় আছেন মৎস্য অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাঠ কর্মকর্তারা। অভিযোগ রয়েছে, নিষেধাজ্ঞার সময় পুলিশের বিভিন্ন শাখায় মাসিক চাঁদা দিয়ে চলে জাটকা নিধন। শরীয়তপুরের আড়তদারদের নাকি প্রতিদিন পুলিশের মেসে খাবারের জন্যও দিতে হয় মাছ। এর মধ্যেও চলে ‘নিয়ম রক্ষার’ জাটকা নিধনবিরোধী অভিযান। তবে অভিযানের খবর ‘বাতাসের আগেই’ যেন চলে যায় মাঝনদীতে জেলে নৌকায়। এসব জমজমাট জাটকা কারবারে ‘মাছের রাজা’ ইলিশের হয়ে যাচ্ছে মহাসর্বনাশ।
মাঝেমধ্যে পিকআপ, বাস ও লঞ্চে পরিত্যক্ত দেখিয়ে জাটকা জব্দ করা হয়। তবে জব্দ জাটকার মালিক ধরতে পেরেছেন– এমন নজির দেখাতে পারেনি মৎস্য অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরিবহন চালক-শ্রমিকদের আটক করে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা কয়েক দিনের কারাদণ্ড দিয়েই যেন দায় শেষ। জাটকা নিয়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও মাঠ প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের এমন গোপন বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এখন ভরা মৌসুমে অভ্যন্তরীণ নদনদীতে ইলিশ সংকট থাকে। ফলে দু’বছর ধরে মৌসুমেও দাম সাধারণ মানুষের আয়ত্তে নেই। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে ভবিষ্যতে খাবারের পাত থেকে ইলিশ হারিয়ে যেতে পারে। অথচ মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ১০ বছর আগের চেয়ে ইলিশ উৎপাদন এখন দ্বিগুণ।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাটকার বিচরণের প্রধান ক্ষেত্র চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা ও শরীয়তপুরে পাশ দিয়ে প্রবাহিত বিশাল মেঘনা ও সংযুক্ত শাখা নদী তেঁতুলিয়া, আড়িয়াল খাঁ এবং কালাবদর। এ ছাড়া দক্ষিণের সাগর মোহনা সংলগ্ন আগুনমুখা, আন্ধারমানিক, বলেশ্বর নদীতেও রয়েছে জাটকার বিচরণ।
মা ইলিশ প্রজননের জন্য মিঠাপানির সন্ধানে দক্ষিণের পাঁচটি মোহনা দিয়ে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে ঢোকে। ডিম ছাড়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এক সেন্টিমিটার আকারে ইলিশের জন্ম হয়। সেগুলো তিন মাস পর্যন্ত মা ইলিশের সঙ্গে নদীতেই থাকে। এ সময়ের মধ্যে আকৃতি ১২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। ৮০ শতাংশ ইলিশ ডিম ছাড়ে আশ্বিন মাসে। ওই ইলিশের বেড়ে ওঠা নিরাপদ করতে ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত এবারও জাটকা নিধন নিষিদ্ধ করেছে মৎস্য অধিদপ্তর। তবে কে শুনছে কার কথা!
জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বৃহত্তর বরিশাল, চাঁদপুর, শরীয়তপুর এলাকার নদনদীতে ছোট ফাঁস জাল ফেললেই জাটকা ধরা পড়ে। স্থানীয় মোকামগুলোতে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ জাটকা পাইকারিতে বেচাকেনা হয়। সেখান থেকে সড়ক ও নৌপথে সারাদেশে চলে যায় জাটকা। এমনকি যেসব মোকামে মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা সশরীরে উপস্থিত থাকেন, সেখানেও প্রকাশ্যে জাটকা বেচাকেনা চলে।
জাটকায় জমজমাট বরিশাল
বরিশাল নগরের বড় মোকামের একটি পোর্ট রোড। বৃহত্তর বরিশালের গুরুত্বপূর্ণ এ মোকামে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বেচাকেনা হয় জাটকা। মোকাম থেকে চোখে দেখা দূরত্বে কোস্টগার্ডের আঞ্চলিক কার্যালয়। মোকামটির দেখভালের দায়িত্বরত মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) ড. বিমল চন্দ্র দাস প্রতিদিন সকাল-বিকেল দু’বার যান ওই মোকামে।
গেল ২১ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৯টায় পোর্ট রোডে গিয়ে অন্তত ১০ মণ জাটকা ডাকে বিক্রি করতে দেখা গেছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে ইজিবাইকে করে আনা হচ্ছিল মণে মণে জাটকা। বিষয়টি মোবাইল ফোনে ড. বিমলকে জানানো হলে– ‘এখনই অভিযান চালাতে আমাদের প্রস্তুতি নেই। আমরা পৌঁছানোর আগে সরিয়ে ফেলবে’ বলে তিনি এড়িয়ে যান। ড. বিমল দাবি করেন, তারা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন। ফাঁকফোকরে বিক্রি হয়।
বরগুনার পাথরঘাটা ও পটুয়াখালীর আলীপুর-মহিপুর এবং গলাচিপার লঞ্চঘাট এলাকাতেও একই অবস্থা। প্রতিটি উপজেলায় মৎস্য কর্মকর্তা, কোস্টগার্ড ও নৌ পুলিশ আছে। তবু পাইকারি বিক্রির জাটকার ট্রাক নির্বিঘ্নে চলে যাচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে।
বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, নদীতে জাটকা নিধন থেকে বাজারে সরবরাহ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। মেঘনার বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মিলন। মেঘনাতীরে তাঁর ২৪ মাছঘাট। পঙ্কজ নাথ এমপির একক আধিপত্যের সময় তাঁর খুব কাছের লোক ছিলেন মিলন। দলীয় পদ হারিয়ে চাপের মুখে পড়লে পঙ্কজকে ছেড়ে বিরোধী গ্রুপের সঙ্গে মিশে যান। পঙ্কজবিরোধী গ্রুপের শীর্ষ নেতা হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক দিপু সিকদারকে করেছেন ব্যবসায়িক অংশীদার। পঙ্কজপন্থি নেতা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বড়জালিয়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন হাওলাদার ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির সভাপতি। তাঁর বিরুদ্ধেও রয়েছে জাটকা ব্যবসার অভিযোগ। মেঘনার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রায় মিলন ও এনায়েতের লোকজন সংঘাতে জড়াচ্ছে। দুই উপজেলা-সংলগ্ন মেঘনার আরেক অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন ধুলখোলা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান জামাল ঢালী, উত্তর উলানিয়া চেয়ারম্যান জামাল মোল্লা, দক্ষিণ উলানিয়া চেয়ারম্যান মিলন চৌধুরী গোবিন্দপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বেল্লাল মোল্লা, সাবেক চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন তালুকদার ও তারেক সর্দার।
রাজনৈতিক আশীর্বাদে প্রায় দুই মাস আগে বরিশাল নগরের পোর্ট রোড মোকামের নিয়ন্ত্রণ নেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের অনুসারী জেলা মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি খান হাবিব। এর আগে টানা ১০ বছর ওই মোকামের ‘মধু’ খেয়েছেন সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারী মহানগর আওয়ামী লীগের শিল্পবিষয়ক সম্পাদক নিরব হোসেন টুটুল। এ মোকামে প্রতিদিন প্রায় ২০০ মণ জাটকা কেনাবেচা হয়। প্রশাসনকে ম্যানেজ করার জন্য প্রতি মণে ৫০০ টাকা করে বরাদ্দ রাখা হয়।
পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করেন আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের উপজেলা সভাপতি জাহাঙ্গীর জমাদ্দার। এখানে জাটকা বিক্রিতে প্রশাসন ম্যানেজের নামে ৫০০ টাকা এবং পুলিশ ম্যানেজে প্রতি মণে ২০০ টাকা করে রাখা হয়। জাহাঙ্গীর জমাদ্দার দাবি করেন, তিনি ৩ বছর আগে মৎস্যজীবী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর জাটকা ব্যবসা বন্ধ করেছেন।
জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ইকবাল হোসেন মাতুব্বর বলেন, নদীতীরের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধি প্রায় সবাই ইলিশ ব্যবসায়ী। তাদের ছত্রছায়ায় জেলেরা জাটকা নিধন ও কেনাবেচা করেন। সবার আগে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
এ ব্যাপারে মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক নৃপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, ‘এবার ইলিশের উৎপাদন বেশি, তাই জাটকা নিধনও বেশি হচ্ছে।’ এসব বন্ধে তিনিও মৎস্য অধিদপ্তরের অন্য কর্মকর্তার মতোই জনবল সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতাকে ছুতা হিসেবে দাঁড় করান। এ কর্মকর্তা স্বীকার করেন, তারা জাটকা জব্দের পর মূল মালিক খোঁজার চেষ্টা করেন না।
চাঁদপুরে জাটকা চক্র
মেঘনায় চাঁদপুর অংশে ৭০ কিলোমিটার এলাকায় যেন চলছে জাটকা হরিলুট। শতাধিক সিন্ডিকেট চাঁদপুরেই প্রতিদিন ধরছে ২০-২৫ টন বিভিন্ন আকারের জাটকা। অভিযোগ রয়েছে, জাটকা প্রকাশ্যে আড়তে না এলেও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নদীর চরে কিংবা মাঝনদীতেই ভ্রাম্যমাণ আড়তে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে হাতবদল হয়ে চলে যাচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে।
চাঁদপুরে রয়েছে ৪০ হাজার ৫ জন নিবন্ধিত জেলে। মেঘনায় বিকেল ৫টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত অবৈধ কারেন্ট জাল দিয়ে জাটকা ধরা হচ্ছে। জেলেরা জানান, একজন মহাজন ও আড়তদারের ২০ থেকে ১০০টি পর্যন্ত নৌকা রয়েছে। এসব নৌকা ৭০ কিলোমিটার মেঘনার বিভিন্ন পয়েন্টে নানা মাছের পাশাপাশি জাটকা ধরছে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, হাইমচরের চরভৈরবী বাজারে আছে ২২টি আড়ত। সেখানে আড়ত পরিচালনা করেন স্থানীয় ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান ইউসুফ জোবায়ের শিমুল চোকদার। তাঁর সঙ্গে আছেন হাইমচর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হুমায়ুন কবির। তিনি আড়ত মালিক সমিতির সভাপতিও। জাটকা সংগ্রহ ও বেচাকেনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আড়তে আমরা জাটকা কেনাবেচা নিষিদ্ধ করেছি। আড়তে পাশেই আছে নৌ পুলিশ ফাঁড়ি, তারাও বিষয়টি দেখছে। তবে নদীতে কারা জাটকা ধরছে, তা আমি জানি না।’
এ ছাড়া একই বাজারে আড়ত পরিচালনা করেন নজরুল ইসলাম, বিল্লাল হোসেন, হাজী বিপ্লব ব্যাপারী ও ফারুক হাওলাদার। অন্যদিকে নীলকমল ইউনিয়নে আড়ত পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি সদস্য দাদন শিকদার, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. বাচ্চু মোল্লা, সাধারণ সম্পাদক বাচ্চু সরকার, ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন গাজী, ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মো. এবাদুল্লাহ। ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা মনির হোসেন গাজী বলেন, ‘আমাদের আড়তে ৩-৪ ইঞ্চি জাটকা কেনাবেচা হয় না। তবে অনেক সময় জালে বড় ইলিশের সঙ্গে ৯-১০ ইঞ্চি বড় জাটকা চলে আসে। পানি থেকে তো ইঞ্চি মেপে ইলিশ ধরা সম্ভব নয়।’
মতলব উত্তর এলাকার কয়েকজন জেলে বলেন, ‘অভিযান শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগেই মহাজনের মাধ্যমে আমরা খবর পেয়ে যাই। এ সময় আমরা নৌকা নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে আসি।’ তারা জানান, অভিযানে আটক কিছু জাটকা মাদ্রাসা ও এতিমখানায় বিতরণ করা হলেও বাকি মাছ কোথায় যায়, তা কেউ জানে না।
আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মানিক মিয়া দেওয়ান বলেন, জাটকা সিন্ডিকেটে চাঁদপুরের কারা জড়িত, সেই তালিকা প্রশাসনের কাছে আমরা দিয়েছি। মৎস্য বিভাগ ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করে না। জেলে ও জাটকা আটক করে এবং জালে আগুন দিয়ে কখনও এ সমস্যার সমাধান সম্ভব না।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমরা জাটকা নিধনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কম্বিং অপারেশন করব।’
নৌ-পুলিশ চাঁদপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘জাটকা ধরা ও ক্রয়-বিক্রয় প্রতিরোধে আমরা প্রতিদিনই অভিযান চালাচ্ছি। তবে নদীতে অভিযান চালানোর জন্য পর্যাপ্ত জনবল ও পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় অভিযান ব্যাহত হয়।’
চাঁদপুর কোস্টগার্ডের স্টেশন কমান্ডার সাব লেফটেন্যান্ট মো. ফজলুল হক বলেন, সবাই সচেতন হলে জাটকা রক্ষা করেই জাতীয় সম্পদ ইলিশের উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব।
চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান সমকালকে বলেন, জাটকা অধ্যুষিত এলাকায় কোস্টগার্ডের একটি জাহাজ টহলে থাকবে। এ ছাড়া নদীর চরে যেখানে জাটকা বিক্রির আড়ত বসে, সেখানে অস্থায়ী নৌ-ক্যাম্প স্থাপন করা হবে।
শরীয়তপুরে পুলিশের ছায়া
শরীয়তপুরের জেলেদের চাঁদপুর-শরীয়তপুর মধ্যস্থানে মাঝনদীতে মাছ ধরতে হলে পাঁচ স্থানে পুলিশের সঙ্গে চুক্তি করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে সুরেশ্বর নৌ পুলিশ ফাঁড়ি, মোহনপুর নৌ পুলিশ ফাঁড়ি, সখীপুর থানা, চাঁদপুর নৌ পুলিশ থানা ও নরসিংহপুর নৌ পুলিশ ফাঁড়ি। জেলেদের অভিযোগ, স্থানীয় পুলিশকে ম্যানেজ করতে বছরে নৌকাপ্রতি দিতে হয় লক্ষাধিক টাকা।
মহাজনের মধ্যস্থতায় জেলেদের সঙ্গে পুলিশের মাসিক চাঁদার চুক্তি হয়। অনেক জেলে আবার পুলিশের স্থানীয় দালালের মাধ্যমে সরাসরি চুক্তি করেন। তবে এ চাঁদার টাকার ভাগ পেয়ে থাকেন স্থানীয় থানা, নৌ পুলিশসহ তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। নির্ধারিত চাঁদার বেশির ভাগ যায় নৌ পুলিশের পকেটে।
জানা যায়, সখিপুর থানার চর সেনসাস ইউনিয়নের নরসিংহপুর নৌ পুলিশ ফাঁড়ির স্পিডবোট চালক শাহিন ও নাজমুল জেলে ও মহাজনদের সঙ্গে ফাঁড়ি ইনচার্জের মাসিক চুক্তির ব্যবস্থা করেন। পরে সেই মাসিক চাঁদার টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ফাঁড়ি ইনচার্জের কাছে পাঠানো হয়।
শরীয়তপুরের সীমানার কাছাকাছি চাঁদপুরের মতলবের মোহনপুর নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জের ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন রাকিব। এর আগে সুরেশ্বর ফাঁড়িতে থাকাকালে রাকিবের সঙ্গে পরিচয় হয় ইনচার্জের। সেখানেও তাঁর হয়ে কাজ করতেন, পরে তাঁকে মোহনপুর নৌ ফাঁড়িতে নিয়ে যান। যেহেতু রাকিবের বাড়ি সুরেশ্বর ঘাটের সঙ্গে এবং সব জেলে ও মহাজনের সঙ্গে ভালো পরিচয় আছে, তাই এই সহকারী জেলে ও মহাজনের সঙ্গে চুক্তি করে দিয়ে থাকেন ইনচার্জের। সেই চুক্তির টাকা ইনচার্জের মোবাইল ব্যাংকিংয়ে পাঠিয়ে দেন তারা। আবার মাঝেমধ্যে তিনিও সেই টাকা সংগ্রহ করে থাকেন। তবে সহকারী রাকিব এখন মোহনপুর নৌ পুলিশ ফাঁড়িতে নেই। তাঁর পরিবর্তে কাজ করেন স্পিডবোট চালক স্বপন।
চাঁদপুর নৌ পুলিশ থানার স্পিডবোট চালক কুদ্দুছ। তিনিই মাসিক চুক্তির সব ব্যবস্থা করেন। এখানেও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে চাঁদার টাকা লেনদেন হয়। কখনও কখনও মহাজনরা একসঙ্গে কয়েকজনের টাকা কুদ্দুছের হাতে দেন। পরে সেই টাকা চলে যায় থানার ওসির কাছে।
সুরেশ্বর নৌ পুলিশ ফাঁড়িটি, সুরেশ্বর মৎস্য আড়তের লাগোয়া হওয়ায় এখানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রয়োজন হয় না। মহাজনরা হাতে হাতে মাসিক টাকা লেনদেনের কাজ সারেন। এখানে প্রতিনিয়ত জাটকা কেনাবেচা হওয়ায় ফাঁড়ি ইনচার্জকে দুটি আড়ত থেকে মাসে ৬ হাজার টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া আড়ত থেকে প্রতিদিন ফাঁড়ির মেস বাবুর্চি মিরাজ ৫ থেকে ৭ হাজার টাকার মাছ নিয়ে যান। পরে কিছু মাছ মেসে খাওয়ার জন্য রেখে, বাকি মাছ ওই বাজারেই বিক্রি করেন। পরে সেই টাকা দিয়ে বাজার করে মেস চালান। ওই ফাঁড়ির কোনো পুলিশ সদস্যকে মেসে খাওয়ার জন্য আলাদা টাকা দিতে হয় না। সারাবছর মাছ উঠিয়ে তাদের মেস চলে।
স্পিডবোট চালক বাদশা মোল্লা ও রহমান মোল্লার মাধ্যমে জেলে ও মহাজনের সঙ্গে চুক্তি হয়। মাসিক টাকা তারা দু’জন সংগ্রহ করে সখীপুর থানার সাব-ইন্সপেক্টর নাজমুল ইসলামের হাতে দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সখীপুরের স্টেশন ঘাটের এক জেলে বলেন, পুলিশের সঙ্গে চুক্তি ছাড়া নদীতে মাছ ধরা যায় না। যারা চুক্তি করে না, তাদেরই শুধু পুলিশ ধরে নিয়ে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক জেলে বলেন, ‘আমি এতদিন সুতার জাল দিয়ে বেলে মাছ ধরতাম, তখন কাউকে টাকা দিতাম না। কয়েকদিন ধরে কারেন্ট জাল নিয়ে জাটকা ধরছি। এ জন্য এখানকার স্পিডবোট চালক বাদশা মোল্লাকে দিয়ে মাসিক চুক্তির ব্যবস্থা করতে হয়েছে। আমার প্রতিমাসে দিতে হয়েছে ১২ হাজার টাকা। এ টাকার মধ্যে সখীপুর থানাকে ৩ হাজার, মোহনপুর নৌ পুলিশ ফাঁড়িকে ৩ হাজার, চাঁদপুর নৌ থানাকে ৪ হাজার ও নরসিংহপুর নৌ পুলিশ ফাঁড়িকে ২ হাজার টাকা দিতে হবে। পুলিশের সঙ্গে চুক্তির সময় সব জেলের নাম ও মোবাইল ফোন নম্বর টুকে রাখা হয়। মাছ ধরার সময় কেউ আটক হলে নাম ও মোবাইল নম্বর বললে ছেড়ে দেয়।
শরীয়তপুর পুলিশ সুপার মাহবুবুল আলম বলেন, ‘সখীপুর থানা পুলিশ জেলেদের কাছ থেকে চাঁদা নেয়– এ ধরনের অভিযোগ আমার কাছে কেউ করেনি। পুলিশের কেউ এ কাজে জড়িত থাকলে সংশ্লিষ্ট সদস্যের বিরুদ্ধে আমি লিগ্যাল অ্যাকশনে যাব।’
এ ব্যাপারে চাঁদপুর নৌ অঞ্চলের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘চাঁদা নেওয়ার খবরটা আমার কাছেও এসেছে। সবাইকে সতর্ক করেছি। তাদের বলেছি, এ বিষয়ে কেউ যদি অভিযোগ নিয়ে আসে তাহলে প্রমাণও নেব না, অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নিয়ে নেব।’
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা)
- বিষয় :
- জাটকা ইলিশ
- ইলিশ