ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

অগ্নিনিরাপত্তায় কোনো সুপারিশই মানা হয়নি

অগ্নিনিরাপত্তায় কোনো সুপারিশই মানা হয়নি

২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে বেইলি রোডে আগুনে বহু প্রাণহানি হয়। ছবি: ফাইল

মো. মাহমুদুল হাসান

প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৪ | ১৯:৪০ | আপডেট: ০৫ মার্চ ২০২৪ | ২০:১৫

রাজধানীবাসীর অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে গত রোববার রাত থেকে অভিযান শুরু হয়েছে। পুলিশ, রাজউক, সিটি করপোরেশনের এ অভিযান আজও চলছে রাজধানীজুড়ে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই অভিযানের পর কী হবে? 

এর আগে পুরান ঢাকার নিমতলী, চকবাজারের চুড়িহাট্টা, বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুনেও সংশ্লিষ্টরা তৎপরতা শুরু করলেও কিছুদিন পর তা থেমে যায়। এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিটি, বিশেষজ্ঞরা সুপারিশ করলেও তা মানা হয়নি। তবে কি শেষ হবে না আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর মিছিল?

গত ১৪ বছরে রাজধানীতে অগ্নিকাণ্ডে ৩০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। এর পরও এসব ঘটনায় দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। বিভিন্ন সময় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশও খেই হারিয়েছে। এসব ঘটনায় মামলা হলেও কোনো মামলার রায়ও দেওয়া হয়নি এখন পর্যন্ত।

বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামের একটি আটতলা ভবনে গত বৃহস্পতিবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে দগ্ধ হয়ে ৪৬ জন মারা যান। বরাবরের মতো এবারও সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো সমালোচনার মুখে পড়ে। জাতীয় সংসদেও অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। হাইকোর্টে তিনটি রিট আবেদন হয়। ভবনমালিকদের দায়মুক্তি দেওয়ার অভিযোগও ওঠে সংসদে। 

এই পটভূমিতে গত রোববার রাত থেকে রাজধানীর রেস্টেুরেন্টগুলোতে অভিযান শুরু করে পুলিশ। এরপর যুক্ত হয় রাজউক, সিটি করপোরেশন। এখনও চলছে অভিযান। গত কয়েকদিনের অভিযানে আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত ৪২টি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে, বন্ধ করা হয়েছে বেশ কিছু রেস্তোরাঁ। 

রাজউক, দক্ষিণ সিটি ও পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে, যে যার মতো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের জীবন বাঁচাতে, অগ্নিঝুঁকি দূর করতে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অভিযান চালাতেই হবে। তবে তা হতে হবে সমন্বিত, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ভিত্তিতে।

অভিযান সমন্বিত কি না, জানতে চাইলে গণপূর্তসচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, রাজউক অভিযান পরিচালনা করছে। সরকারের অন্য দপ্তরগুলোর জনবলের অভাব ও অন্য কাজের চাপে অভিযান পরিচালনা করতে পারছে না। ফলে সব সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে এখন অভিযান চালানো যাচ্ছে না। পরে সমন্বয় করে অভিযান চালানো হবে।

পুলিশের অভিযান

গত দুই দিনে (রোব ও সোমবার) পুলিশ ২৮৫টি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়েছে। এতে ৩৭৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ২০৪টি। আজও অভিযান চলছে বলে জানায় ডিএমপি।

সিটি করপোরেশনের অভিযান

সাতমসজিদ রোডের কেয়ারি ক্রিসেন্ট প্লাজায় অভিযান চালানো হয়। অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পরিদর্শন শেষে অগ্নিঝুঁকির কারণে ভবনটি সিলগালা করে দেওয়া হয়। ভবনটিতে ১১টি রেস্তোরাঁ ছিল। জিগাতলার পর সাতমসজিদ সড়কের রূপায়ণ জেড আর প্লাজায় অভিযান চালানো হয়। সেখানে তিনটি রেস্তোরাঁকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির মুখপাত্র ও জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের বলেন, ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে তারা এই অভিযান পরিচালনা করছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর ২ হাজার ৬০৩টি ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি- ১ হাজার ১০৬টি বিপণিবিতান। ৮০১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৩৪৫টি হাসপাতাল ও ৩২৫টি আবাসিক ভবন রয়েছে ঝুঁকির তালিকায়। 

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, সারা দেশে ২০২৩ সালে ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আগুনে নিহত হয়েছেন ১০২ জন ও আহত হয়েছেন ২৮১ জন। সংস্থাটি বলছে, বৈদ্যুতিক গোলযোগ, বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা, চুলা ও গ্যাসের লাইন থেকে আগুনের ঘটনা বেশি ঘটেছে। 

রাজউকের অভিযান

ধানমন্ডির গাউসিয়া টুইন পার্কে অভিযানে রাজউকের অঞ্চল-৩-এর পরিচালক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজিনা সারোয়ারের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা করা হয়। ভবনটি ১৫ তলার। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল এফ-১ ক্যাটাগরিতে, অর্থাৎ অফিস হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু সেখানে অফিস রয়েছে। এভাবে দিনভর অভিযান পরিচালনা করে রাজউক। এভাবেই গত রোববার থেকে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

ঢাকায় অগ্নিঝুঁকি নিয়ে বেশি আলোচনা তৈরি হয় ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ আগুনে ১২৪ জনের মৃত্যুর পর। এরপর বিভিন্ন সময় সরকারি সংস্থাগুলো অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু সমন্বিত, কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদি অভিযান হয়নি।

রেস্তোরাঁমালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের অনিয়ম এখন অন্যের ওপর চাপানো হচ্ছে। ভবনমালিকেরা প্রভাবশালী হওয়ায় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন। কিন্তু ছোট ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। দোষ এখানে একজনের নয়। সবার নাকের ডগায় এসব বছরের পর বছর চলে আসছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সবারই আলাদা দায়িত্ব আছে। রাজউকের দায়িত্ব সারা বছর ভবনকে নজরদারিতে রাখা। ফায়ার সার্ভিসের কাজ একই। তিনি বলেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় যেভাবে সমন্বিত পরিকল্পনা করে কাজ করা হয়েছিল, সেটাই দরকার।

এর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীর ভয়াবহ আগুনে অন্তত ১২৩ জনের মৃত্যু দেখে দেশ। ঘটনাটি এখনও সবার মনে দাগ কেটে আছে। এরপর গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি রাজধানীকে অগ্নিঝুঁকিমুক্ত করতে ১৭ দফা সুপারিশ করে। এর মধ্যে অন্যতম সুপারিশ ছিল পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম স্থানান্তর ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুসরণ করা। ওই সময় শিল্প মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে রাসায়নিক গুদামগুলো শ্যামপুর, কেরানীগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত ১৪ বছরেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। 

নিমতলীর ঘটনার ৯ বছর পর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে মারা যান আরও অন্তত ৭১ জন। একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে নেভে ২৬ প্রাণ। এ ছাড়া মগবাজার, নিউমার্কেট, বঙ্গবাজার, সিদ্দিকবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে মাঝে মাঝেই অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এভাবে গত ১৪ বছরে রাজধানীতে বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ২৬৭ জনের মৃত্যু হয়। 

জানা গেছে, রাজধানীকে অগ্নিঝুঁকিমুক্ত করতে বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশে আরও ছিল রাসায়নিক গুদামে রাজধানীর বাইরে বা প্রান্তসীমায় স্থানান্তর, যাচাই-বাছাই করে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া, অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত না থাকলে ভবন মালিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া, নকশাবহির্ভূত কোনো অবকাঠামো তৈরি না করা উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এসব সুপারিশ কখনও আলোর মুখ দেখেনি।

এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ আকতার মাহমুদ বলেন, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা স্থানান্তরই ছিল প্রধান সুপারিশ। সেটা যখন বাস্তবায়ন হয়নি তখন সহজেই বোঝা যায়, অন্য সুপারিশও কার্যকর হয়নি। আর বিএনবিসির অধ্যায় ৭-এ ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি স্বাধীন ইমারত নির্মাণ কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা আছে। সেটাও গঠন হয়নি।

এদিকে অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩-এ স্পষ্টভাবে বলা আছে, অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত না করলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অভিযুক্ত ভবন মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে। মামলায় সর্বনিম্ন ছয় মাসের জেলের বিধানও উল্লেখ আছে। কিন্তু অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত না করার দায়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মামলার তেমন নজির নেই। বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের পর তারা একটি মামলা করে, যেটা ফায়ার সার্ভিসের ভবনে হামলা করার অভিযোগে।

এ ছাড়া গত কয়েক বছরে বঙ্গবাজার, মগবাজার, নিউমার্কেটসহ ঢাকায় বেশ কয়েকটি বড় অগ্নিদুর্ঘটনায় মামলা হয়। কিন্তু কোনো ঘটনারই বিচার শেষ হয়নি। এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার বেইলি রোডে আগুনে বহু প্রাণহানির পর প্রশ্ন উঠেছে- এ ঘটনার বিচার আদৌ হবে কি? রাজধানীবাসীর আগুনে পুড়ে অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর সংখ্যা কি ক্রমাগত বেড়েই যাবে? থামবে না?

আরও পড়ুন

×