ব্যয় বেড়েছে ডায়ালাইসিসে, নিঃস্ব হচ্ছে বহু পরিবার

প্রতীকী ছবি
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৪ | ০৭:২৪ | আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৪ | ১০:২১
দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ। তাদের মধ্যে প্রতিবছর ৪০ হাজার রোগীর রক্ত ছেঁকে শরীর থেকে তরল বর্জ্য বের করতে ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয়। বছরের শুরুতেই এই ডায়ালাইসিস সেবার মূল্য বেড়েছে। সরকারিতে ৫ শতাংশ ও বেসরকারিতে হাসপাতাল ভেদে প্রতি সেশনে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা বেড়েছে। এ চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল হওয়ায় অর্থ সংকটে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দেন বেশির ভাগ রোগী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজন চিকিৎসা না পেয়ে রোগীদের ৯০ শতাংশ মারা যায়। মূলত একদিকে ব্যয়বহুল চিকিৎসা অন্যদিকে চিকিৎসা সুবিধা অপ্রতুল হওয়ায় রোগীদের ভোগান্তি বাড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলে দেশে ১৬০টি ডায়ালাইসিস সেন্টার রয়েছে। সব মিলিয়ে ২ হাজার ৫০০টি ডায়ালাইসিস মেশিনে দৈনিক ১০ হাজার রোগীর সেবা দেওয়া হচ্ছে। এর বেশির ভাগ ঢাকায়। রাজধানীর বাইরে ডায়ালাইসিসের সুযোগ তেমন নেই। এ ছাড়া সরঞ্জাম আমদানি এবং কিছু ওষুধের খরচ বেশ উচ্চ।
ডায়ালাইসিসের জন্য সরকার নির্ধারিত কোনো ফি নেই। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে একক ডায়ালাইসিসের খরচ ৪০০ টাকা থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। বেসরকারি হাসপাতালে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা লাগে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০২২ সালের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করতে খরচ হয় ২ হাজার ৮০০ টাকা। আর ডায়ালাইজার পুনর্ব্যবহার করলে খরচ হয় ১ হাজার ৭০০ টাকা। বেসরকারি হাসপাতালে এই খরচ ৫ হাজার টাকা বা তার বেশি। তবে সরকারি হাসপাতালে ২০ হাজার টাকায় ছয় মাসে ৪৮টি ডায়ালাইসিস হয়। প্রতিটি ডায়ালাইসিসের জন্য ৪০০ টাকা নেওয়া হয়, যা সরকারের রাজস্ব খাতে চলে যায়। আর বাকি টাকা সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, শিডিউল পাওয়া একজন রোগীর কাছ থেকে প্রতিবার ডায়ালাইসিসের জন্য বর্তমানে নেওয়া হয় ৫৬৩ টাকা। ২০২৩ সালে খরচ ছিল ৫৩৫ টাকা আর ২০২২ সালে ৫১০ টাকা। দুই বছরের ব্যবধানে প্রতি ডায়ালাইসিসে খরচ বেড়েছে ৫৩ টাকা। অন্যদিকে শিডিউল ছাড়া প্রতিবার ডায়ালাইসিস করাতে খরচ হয় ৩ হাজার ৮০ টাকা। এটা গত বছর ছিল ২ হাজার ৯৩৫ টাকা এবং তার আগের বছর ছিল ২ হাজার ৭৮৫ টাকা। দুই বছর আগে বিশেষায়িত হাসপাতালটিতে প্রতি মাসে ৮টি ডায়ালাইসিসের জন্য একজন রোগীর খরচ হতো ২২ হাজার ২৮০ টাকা। বর্তমানে দিতে হয় ২৪ হাজার ৬৪০ টাকা।
এই হাসপাতালের মতোই খরচ বেড়েছে কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল, আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতাল, ল্যাবএইড ও স্কয়ার হাসপাতালে। এসব হাসপাতালে প্রতিবার ডায়ালাইসিসের খরচ এক হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
একাধিক কিডনি রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাতে যাতায়াত, খাবার, টেস্টের খরচ, ওষুধপত্রসহ ইনজেকশন কেনা মিলে এক দিনে খরচ হয় ২-৫ হাজার টাকা। আর বেসরকারি হাসপাতালে প্রতি ডায়ালাইসিস করাতে খরচ হয় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। কোনো কোনো রোগীর সপ্তাহে দু’বার ডায়ালাইসিস করাতে হয়। কারও আবার তিনবার। এসব রোগীর খরচ আরও বেশি হয়।
বুধবার আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে ডায়ালাইসিস রুমের সামনে কথা হয় মায়ের চিকিৎসা করাতে আসা হাসান ইমামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এক বছর ধরে এখান থেকে মায়ের ডায়ালাইসিস করাচ্ছি। সপ্তাহে দুইবার আসতে হয়। প্রতিবার ডায়ালাইসিসের জন্য ৪ হাজার ৪০০ টাকা দিতে হয়। প্রতি মাসে ওষুধপত্র কেনা, আসা-যাওয়াসহ ৬০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়। শুরুর দিকে মাসে ৪০ হাজার টাকা লাগত। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ১৮ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। মায়ের চিকিৎসা করাতে আমাদের পুরো পরিবার এখন নিঃস্ব হওয়ার পথে।’
ল্যাবএইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, গত বছর হাসপাতালটিতে ডায়ালাইসিসের খরচ ছিল ৪ হাজার টাকা। চলতি বছর বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৫০০ টাকা। স্কায়ার ও ইউনাইটেড হাসপাতালেও ডায়ালাইসিস সেবার মূল্য বাড়ানো হয়েছে এক হাজার টাকা করে।
বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে সবচেয়ে কম মূল্যে ডায়ালাইসিস দেয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। এই কেন্দ্রে তিন ভাগে ডায়ালাইসিস দেওয়া হয়। সর্বনিম্ন ১ হাজার ৪০০, এর পরের ধাপে ২০০০ এবং সর্বোচ্চ মূল্য ২ হাজার ৪০০ টাকা।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে পরিচালক অধ্যাপক বাবরুল আলম বলেন, এ হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার ২০১৭ সালে ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পিপিপি (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) চুক্তি করে। ওই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী প্রতি বছর ৫ শতাংশ করে ফি বাড়ানো হয়। এবারও ফি বাড়ানো হয়েছে। এখানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কিছু করার নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক অধ্যাপক আহমেদুল কবীর বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস মূল্য নিয়ে দ্রুত আলোচনা করা হবে। এ ছাড়া সরকারিভাবে ডায়ালাইসিস সেবার প্রসারে সরকার ৪৪টি জেলায় ১০ শয্যার ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপনে কাজ করছে। সবমিলিয়ে ১ হাজার ৫০০ শয্যার আইসিইউ শয্যা প্রতিস্থাপনে কাজ চলছে। এগুলো হলে কিডনি রোগীদের দুর্ভোগ কিছুটা হলেও কমবে।
- বিষয় :
- ডায়ালাইসিস
- কিডনি
- কিডনি সংযোজন
- কিডনি ডায়ালাইসিস