ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ কবে বাজেয়াপ্ত

মহান স্বাধীনতা দিবস

যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ কবে বাজেয়াপ্ত

প্রতীকী ছবি

 আবু সালেহ রনি

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৪ | ০০:৪২ | আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৪ | ০৯:৫২

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর এ দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ পর্যন্ত ১৫৫ জনের সাজা হলেও তাদের কারও সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়নি। 

২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের সময় যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে পৃথক আইন করার কথা জানিয়েছিল সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে যুদ্ধাপরাধীদের পৃষ্ঠপোষক ১২৭টিরও বেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ এটি ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া হয়। তবে এক দশকেও তালিকাটি আলোর মুখ দেখেনি।

তদন্ত সংস্থা বলছে, সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ে ট্রাইবুন্যাল সিদ্ধান্ত দেবেন। অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন জানিয়েছে, সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার আইনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বিষয়টি জাতীয় সংসদেও উত্থাপিত হয়েছে। ২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সংসদে তৎকালীন সদস্য ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পী (প্রয়াত) বিষয়টি প্রস্তাব আকারে উত্থাপন করেন। সর্বসম্মতভাবে ওই প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। তবে এ নিয়ে আইন করা হয়নি।

এদিকে, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে জামায়াতের বিচার শুরুর পাশাপাশি দলটির অর্থের উৎস চিহ্নিত করে রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার দাবি জানিয়েছেন শহীদ পরিবারসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধি। তারা বলছেন, দল হিসেবে জামায়াতের বিচার করলেই হবে না, অর্থের উৎসও বন্ধ করতে হবে। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা যেসব প্রতিষ্ঠানের তালিকা করেছে, সেগুলোসহ দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতে হবে। বিশ্বের বহু দেশেই স্বাধীনতাবিরোধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে শহীদ পরিবারের সদস্যদের দেওয়ার নজির রয়েছে। কারণ যুদ্ধে শহীদ পরিবারই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ব্যবস্থা না নিলে স্বাধীনতাবিরোধীরা আর্থিকভাবে আরও শক্তিশালী হবে।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির সমকালকে বলেন, ‘আমরা বহুবার যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতসহ তার দোসর সংগঠনের বিচারের কথা বলেছি। যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্তেরও দাবি জানিয়েছি। সরকার বিভিন্ন সময় এ বিষয়ে আইন করার কথা জানিয়েছে। কিন্তু কোন যুক্তিতে আইন হচ্ছে না, এটা বোঝা যাচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, যুদ্ধাপরাধীরা লাখ লাখ শহীদের সম্পদ লুণ্ঠন করে বিত্তশালী হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ তার উত্তরাধিকাররা ভোগ করছে। অথচ  শহীদ পরিবার অসহায় হয়ে রাস্তায় ঘুরছে। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হারিয়ে তারা নিঃস্ব। তাঁর মতে, আইন ছাড়া সম্পদ বাজেয়াপ্তের সুযোগ নেই। কারণ দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীরা এরই মধ্যে বিভিন্নভাবে তাদের সম্পদ হস্তান্তর করেছে। এ জন্য আইনের আলোকে একটি কমিশনও গঠন করতে হবে।

২০১৪ সালে ২৭ মার্চ ৩৭৩ পৃষ্ঠার ‘তদন্ত প্রতিবেদন’ ও ৯ হাজার ৫৫৭ পৃষ্ঠার আনুষঙ্গিক তথ্য-উপাত্ত ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমের কাছে দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মতিউর রহমান। প্রতিবেদনে বলা হয়, জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় সারাদেশে ১২৭টি প্রতিষ্ঠান ধর্মের নাম ব্যবহার করে নানা কৌশলে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখে আর্থিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছে। এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুফল পাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। সমকালের কাছে এসব প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকা রয়েছে। এর মধ্যে আছে দেশি-বিদেশি এনজিও ৪৩টি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২২ এবং হাসপাতাল-ক্লিনিক ১০টি। প্রতিবেদনে জামায়াত ও এর সহযোগী সংগঠন আলবদর, আলশামস, রাজাকারসহ তাদের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামকে বিচারের মুখোমুখি করতে আইনগত বিষয় খতিয়ে দেখার জন্যও প্রস্তাব করা হয়েছে।

তালিকার বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাইবুন্যালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক এম সানাউল হক সমকালকে বলেন, ‘বহুদিন আগের বিষয়। তালিকাটি প্রসিকিউশনের কাছে থাকার কথা। তাদেরই আদালতে উপস্থাপন করার কথা। সম্পদ বাজেয়াপ্তের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আদালতই দেবেন।’ এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী সমকালকে বলেন, ‘আদালতে কোনো বিষয় উপস্থাপন করতে হলে সংশ্লিষ্ট সেই আইনে ধারা উল্লেখ করে করতে হয়। সম্পদ বাজেয়াপ্তের বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস (আইসিটি) আইনের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিষয়টি সরকারেরও নজরে রয়েছে। তাই যুদ্ধাপরাধী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের সম্পদ বাজেয়াপ্তের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এখন সরকার যদি আইসিটি আইন সংশোধন করে যুদ্ধাপরাধী দল ও তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্তের বিধান যুক্ত করে, তাহলে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।’

জানা গেছে, তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠান ও দণ্ডিত ব্যক্তিদের সম্পদ হস্তান্তরের বিষয়ে রাষ্ট্রীয় কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। এসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সম্পদ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে আইনি প্রক্রিয়ায় অনুমোদনের ভিত্তিতে হয়েছে। তাই এসব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। এসব কারণেই আইন প্রণয়নের বিষয়টি থমকে আছে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে আইনমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ে আইন প্রণয়নের কথা জানিয়েছিলেন।

গত রোববার এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সমকালকে বলেন, ‘এ বিষয়ে এখন কিছু বলা যাচ্ছে না।’ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্তের বিষয়ে তিনিও একমত। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয় নয়। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীব সমকালকে বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে গণহত্যা ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে যারা ছিল, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্তের জন্য আইন করা হয়েছে। কিছু দেশে এরই মধ্যে সম্পদ বাজেয়াপ্তের নজির রয়েছে। তবে বহু দেশেই যুদ্ধের পর জাতীয় সমঝোতা হলে তখন আর শত্রুমিত্র থাকে না। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাস দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভিন্ন। কারণ পাঁচ দশকের বেশি সময় চলে যাওয়ার পরও স্বাধীনতাবিরোধীরা সুসংহতভাবে স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচারণ করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের অনেকে এখনও দেশে ধনে-মানে প্রতিষ্ঠিত। তাদের অর্থ দেশের মৌল সমাজকাঠামো এবং গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তবে এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে গেলে সংশ্লিষ্ট সবার মত নিয়ে আইন করতে হবে। সরকার বহুবার বললেও আইন করছে না। আইনের খসড়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কেই করতে হবে।’

জেনোসাইড (গণহত্যা) বিষয়ে পোস্টডক্টরাল গবেষণা কাজে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের সন্তান তৌহীদ রেজা নূর সমকালকে বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্তের জন্য যারা অপরাধ সংঘটিত করে তাদের অপরাধ স্বীকার করতে হয়। তখন যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত শহীদ পরিবার বা অন্যদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্ন আসে। বিষয়টি আদালতে নিষ্পত্তি হয়। এ জন্য আইন দরকার। বাংলাদেশে এখনও আইন হয়নি।’ কম্বোডিয়াসহ অনেক দেশেই ক্ষতিপূরণ বাবদ পাওয়া অর্থ শহীদ পরিবারে পুনর্বাসনসহ গবেষণা কাজে ব্যবহৃত হয় বলে জানান তিনি।
ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, গত ১৪ বছরে ট্রাইব্যুনালে ৫৫টি মামলার রায় হয়েছে। এসব মামলায় সাজা হয় ১৮৮ যুদ্ধাপরাধীর। এর মধ্যে ১০৬ জনের মৃত্যুদণ্ড, ২৫ জনের আমৃত্যু কারাদণ্ড, ১২ জনের যাবজ্জীবন এবং ১২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে ৬২ জন পলাতক। তবে দণ্ডিত কারও সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়নি। রায়ের নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকের বিরুদ্ধে শুধু হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, নির্যাতনের অভিযোগই নয়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পদ লুট, সম্পত্তি দখল করে তাদের বিতাড়ন করা, ওই সম্পত্তি ভোগ করা এবং সাধারণ স্বাধীনতাকামীদের সম্পদ লুটের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।

আরও পড়ুন

×