ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

থামছে না পাহাড়ের কান্না

চট্টগ্রামে ১২০ ও তিন জেলায় শতাধিক পাহাড় বিলুপ্ত

থামছে না পাহাড়ের কান্না

যে যেভাবে পারছে দখল করে নিচ্ছে লালমাই পাহাড়ের জমি। বাদ যায়নি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও। ছবি: সমকাল

 জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ০৫ মে ২০২৪ | ০০:৫৭ | আপডেট: ০৫ মে ২০২৪ | ০৭:০৮

একটি-দুটি নয়, দেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে শত শত পাহাড়। সবার চোখের সামনে কীভাবে এত এত পাহাড় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে– সেই প্রশ্নের উত্তর জানা। মামলা হয়, অভিযান চলে, বিপন্ন পাহাড় বাঁচাতে আদালতের নির্দেশনাও আসে, তবু পাহাড়ের কান্না থামে না। প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, এমনকি পারিবারিক স্থাপনাও গড়ে উঠছে পাহাড় কেটে। এই ধ্বংসযজ্ঞে পিছিয়ে নেই সরকারি প্রতিষ্ঠানও। 

বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, পাহাড় কাটছে প্রভাবশালীরা। জনবল সংকটে তাদের বিরুদ্ধে সব সময় অভিযান চালানো সম্ভব হয় না, জীবনের ঝুঁকিও আছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা নিয়েও রয়েছে অনেক অভিযোগ। এমন বাস্তবতায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে থাকা একেকটি পাহাড়। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। বিপন্ন হয়ে পড়ছে প্রাণ-প্রকৃতি। কাটা পাহাড়ে বসবাসকারীরাও পড়েছেন জীবনের ঝুঁকিতে। 

পরিবেশবিদরা বলছেন, পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িতরা এতটাই প্রভাবশালী যে, আইন-আদালতও তারা তোয়াক্কা করেন না। পাহাড় রক্ষার দায়িত্বে থাকা লোকজনকে মেরে ফেলেন। প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা করেন। অথচ পাহাড় রক্ষায় দেশে আইন আছে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, প্রতিটি পাহাড় কাটার ঘটনার পেছনে থাকে মোটা অঙ্কের বাণিজ্য, যার সঙ্গে যুক্ত প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা।  

আইন যা বলে

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ অনুযায়ী, ‘পাহাড় কাটা আমলযোগ্য অপরাধ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যক্তি পাহাড় কাটতে বা নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না। যদি কেউ এটি অমান্য করে, তবে তাকে অথবা ওই প্রতিষ্ঠানকে দুই বছর কারাদণ্ড অথবা ২ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। ফের একই অপরাধ করলে, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ১০ বছর কারাদণ্ড অথবা ১০ লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হবে।’

হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়-টিলা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খালেদ মেসবাহুজ্জামানের এক গবেষণায় বলা হয়, ১৯৭৬ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচটি থানা এলাকার ১২০টি পাহাড় কেটে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে, যার আয়তন ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার। নগর উন্নয়নের নামে খোদ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) প্রায় ২০টি পাহাড় কেটে ধ্বংস করেছে। অধ্যাপক ড. খালেদ মেসবাহুজ্জামান বলেন, ‘পাহাড় হলো প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় খুঁটির মতো, যা দুর্যোগ প্রতিহত করার পাশাপাশি সুপেয় পানির নিশ্চয়তা দেয়। ক্রমাগত পাহাড় ধ্বংস হলে চট্টগ্রাম মহানগরীতে সেই নিশ্চয়তা থাকবে না।’ 

পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই বিভাগের চার জেলায় ১ হাজার ৮৭৫টি টিলা রয়েছে, যার আয়তন ৪ হাজার ৮১১ একর। গত আড়াই দশকে এর অন্তত ৩০ শতাংশ টিলা কেটে ফেলা হয়েছে। পরিবেশবিদদের হিসাবে শতাধিক পাহাড় কাটা হয়েছে বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে। 
 
পাহাড় ধ্বংসে সরকারি প্রতিষ্ঠানও 

শুধু প্রভাবশালী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয়, পাহাড় কাটছে সরকারি প্রতিষ্ঠানও। খোদ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বনভূমি। কক্সবাজারের শুকনাছড়ি এলাকায় ৭০০ একর পাহাড়ি বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ একাডেমি নির্মাণে। তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশে আপাতত স্থগিত রয়েছে সেই বরাদ্দ। এই বরাদ্দের সময় আপত্তি জানিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেয় বন বিভাগ। ওই চিঠিতে বলা হয়, একাডেমি স্থাপনে পাহাড়ের পাশাপাশি কাটা পড়বে প্রায় ৩০ হাজার গাছ। এতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পরিবেশ। এ ছাড়া কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের পাশে খুনিয়াপালং মৌজায় ২০২২ সালের ৪ জুলাই ২৫ একর সংরক্ষিত বন দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে (বাফুফে)।

২০২২ সালে কক্সবাজার বিভাগীয় বন কার্যালয় থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার কক্সবাজারে ৩২টি প্রতিষ্ঠানকে ৩ হাজার ২৮৮ একর বনভূমি বরাদ্দ দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকায় রয়েছে সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট, শহীদ এটিএম জাফর আলম মাল্টিডিসিপ্লিন একাডেমি ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। আইনের তোয়াক্কা না করে কেউ কেউ জমি বরাদ্দ পাওয়ার আগেই পাহাড় কেটে স্থাপনা তৈরি শুরু করেছেন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পাহাড় কেটে তৈরি করেছে লেক সিটি হাউজিং। ফৌজদারহাট-বায়েজিদ বাইপাস সড়ক নির্মাণে ১৫টি পাহাড় কেটেছে সিডিএ।

পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদ বলেন, ‘পরিবেশ রক্ষায় আসলে সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। সরকারি সব সংস্থার কার্যকর পদক্ষেপে পরিবেশবিনাশী কর্মকাণ্ড থামতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা পাহাড়ের মালিক নই, শুধু দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করি। নিয়মিত মামলা করছি, জরিমানাও করছি।’ 

মামলায় থামে না পাহাড় কাটা

শুধু কক্সবাজার জেলায় পাহাড় কাটার ঘটনায় ২০০টি মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। আর বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এই জেলায় মামলা করেছে ১০টি। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামে পাহাড় কাটার ঘটনায় ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৯২টি মামলা করেছে। ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি বেলার এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বিভাগের পাঁচ জেলার সব পাহাড়ের তালিকা (দাগ ও খতিয়ানসহ) এবং বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এরই মধ্যে কাটা হয়েছে এমন পাহাড়ে দেশি প্রজাতির বৃক্ষরোপণ এবং দেয়াল দিয়ে পাহাড়গুলো সুরক্ষিত করার নির্দেশ দেন। তিন মাসের মধ্যে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের ওই প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হলেও এখনও তা কার্যকর হয়নি। 

বাস্তবতা হলো, পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করে, অভিযান চালায় কিন্তু পাহাড় কাটা বন্ধ হয় না। অভিযানের সময় জরিমানা করা হয়। জরিমানা দিয়ে অনেকে মনে করেন, তারা বৈধতা পেয়ে গেছেন। কিছুদিন পর আবার পাহাড় কাটা শুরু করেন। চট্টগ্রামে পরিবেশ আদালতের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর (স্পেশাল পিপি) অ্যাডভোকেট হুমায়ুন রশিদ তালুকদার বলেন, ‘মামলা করার পর অভিযোগপত্র দাখিল ও শুনানি শেষে রায় দিতে দুই থেকে তিন বছর লেগে যায়। ফলে রায়ের পর অনেক পাহাড়ের আর অস্তিত্ব থাকে না। একইভাবে পুকুর ভরাট মামলার রায়ের পর দেখা যায় অনেক জায়গায় ভবনও উঠে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটা ঘটনা নিয়ে মামলা হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতিনিধিরা আর স্পটে যান না। এই সুযোগের দুর্বৃত্তরা পাহাড়টি কেটে ফেলে।’

পাহাড় কাটা মামলায় আসামিরা দ্রুতই জামিনে বের হয়ে আসছেন, সে কারণেও পাহাড় কাটা বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘মামলা শেষে রায়ে হয়তো তারা জরিমানা দিয়েই পার পেয়ে যাচ্ছেন। তাই মামলাটি যদি জামিন অযোগ্য করা হয়, তাহলে হয়তো পাহাড় কাটা কমে আসবে। তখন জেলে থাকার ভয়ে পাহাড় কাটায় জড়িত প্রভাবশালীরা এই অপরাধ করবেন না।’ 

২০০৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে দায়ের হওয়া ৮৩টি মামলার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মাত্র একটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। বাকি ৮২টি মামলার মধ্যে চার্জশিট দাখিল হয়েছে ৫০টির ও তদন্তাধীন রয়েছে ৩২টি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবেশ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘বেশি দেরি হলে মামলা দুর্বল হয়ে যায়, অভিযুক্তরা দোষী প্রমাণিত হলেও পাহাড় রক্ষা করা যায় না।’

মাটি পাচারকারীদের মিনি ট্রাকের চাপায় সম্প্রতি কক্সবাজারে খুন হয়েছেন বনবিট কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান। প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, ‘পাহাড়-বন রক্ষায় কতটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে হয়, তা ঢাকায় বসে বোঝা সম্ভব নয়। বনকর্মীরা সারাক্ষণ ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। অথচ তাদের ঝুঁকিভাতা নেই।’ 

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে কথা বলছি বহুদিন ধরে। কারা পাহাড় কাটছে, সেই তালিকা আমার-আপনার কাছে না থাকলেও সরকারের কাছে রয়েছে। অনেকের নাম সামনে এলেও সরকার শাস্তি দিতে চায় না। ২০১১ সালে আদালত এক রায়ে চট্টগ্রাম নগরের সব পাহাড় কাটা বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু সিটি করপোরেশন ও সিডিএ সেই দায়িত্ব একেবারে পালন করেনি। ফলে পাহাড় কাটা অব্যাহত রয়েছে। সিডিএ নিজেই পাহাড় কেটে সড়ক করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত বছর আদালতের অপর এক আদেশে বিদ্যমান পাহাড়গুলোর তালিকা প্রস্তুত করে সেগুলো রক্ষা করতে বলা হয়। সেই সঙ্গে ইতোমধ্যে কেটে ফেলা পাহাড়ে গাছ লাগানোর নির্দেশ দেন আদালত। সে কাজটিও হয়নি। ২০১২ সালে আদালত পাহাড় কাটা নিয়ে রায় দিলেও দীর্ঘ ১১ বছরে সেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। এভাবে চলতে থাকলে দেশ এক সময় পাহাড়শূন্য হয়ে পড়বে।’ 

আরও পড়ুন

×