বহু পরিবারে অশান্তি-কলহ
অনলাইন জুয়ায় নিঃস্ব তরুণ
কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে আসক্ত হয়ে পড়েছে স্কুল-কলেজের অনেক শিক্ষার্থী

প্রতীকী ছবি
আহমেদ রাজু, দৌলতপুর (কুষ্টিয়া)
প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৪ | ০০:৪৮
অনলাইন জুয়া বা বেটিংয়ে আসক্ত হয়ে পড়েছে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ। জুয়ার ‘ভার্চুয়াল বিষ’ ছড়িয়ে পড়ছে শ্রমজীবী মানুষের মাঝেও। সর্বস্ব খুইয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। জুয়ার নেশা অশান্তি-কলহের পাশাপাশি অনেক পরিবারকে বিপন্ন করে তুলছে। তবে অনলাইন জুয়া নিষিদ্ধ হলেও এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা নেই বললেই চলে। ফলে ঝুটঝামেলা ছাড়াই তরুণরা বাড়ি, রাস্তাঘাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বসেই জুয়া চালিয়ে যাচ্ছে।
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা প্রলোভন দেখিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় এসব জুয়া বা বেটিং সাইটের। বুঝে না বুঝে কেউ একটি ক্লিক করলেই অ্যাপস কিংবা ওয়েবসাইটের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। শুরুতে সদস্য টানতে নেওয়া হচ্ছে কৌশল। অল্প টাকায় লাখপতি হওয়া বা দ্বিগুণ মুনাফার লোভে অন্ধকার এ জগতে পা বাড়াচ্ছে মানুষ। একসময় লোভে পড়ে বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে নামে। তখনই বেরিয়ে আসছে আসল বাস্তবতা। কারও কারও টাকা মুহূর্তেই হারিয়ে যাচ্ছে জুয়ার বোর্ডে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দৌলতপুরের কয়েক হাজার মানুষ বেটিং বা অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত। অধিকাংশই স্কুল-কলেজে পড়ুয়া তরুণ। জুয়ার টাকা জোগাতে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। ক্রমেই বাড়ছে আসক্তের সংখ্যা। চটকদার বিজ্ঞাপনের কারণে যারা জুয়ায় বাজি ধরেছে, তাদের খুব কম সংখ্যকই বড় ক্ষতি ছাড়া বেরিয়ে এসেছে। অনলাইন জুয়ায় প্রতিদিন এ উপজেলায় প্রায় অর্ধকোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। প্রতিটি গ্রামেই বেটিং ছড়িয়ে পড়েছে।
ভারতের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আইপিএলের ম্যাচগুলোকে কেন্দ্র করে বসছে জুয়ার আসর। কোন ব্যাটসম্যান কত রানে আউট হবেন, কারও সেটা নিয়ে বাজি ধরার ইচ্ছা হলে স্ক্রিনে ভেসে উঠছে জুয়ার একাধিক সাইট। দেশি-বিদেশি এসব অ্যাপস ও সাইটে ব্যাটসম্যানের রানের ওপর জুয়ার রেট দেখানো হচ্ছে। এগুলো মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারে ইনস্টলের পর সেখানে রেজিস্ট্রেশন বা অ্যাকাউন্ট খুলে ঘরে বসেই খেলা যায় জুয়া।
একাধিক অনলাইন বেটিং অ্যাপসে প্রবেশ করে দেখা যায়, সেগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় অফার সংবলিত পসরা সাজিয়ে বসে আছে। কোন টিম কত রান করবে, কোন টিম জয়ী হবে, কোন খেলোয়াড় কত রান বা উইকেট পাবে, কোন ওভারে কত রান হবে– এমন বহু আইটেম। কোন আইটেমের জন্য কত টাকা রেট তাও উল্লেখ করা রয়েছে। নিজ নিজ পছন্দের ইভেন্টে জুয়া ধরা যায়। এজন্য প্রথমে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অ্যাপসের অ্যাকাউন্টে টাকা লোড করা হয়। পরে ওই অ্যাকাউন্ট থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ জুয়ায় লগ্নি করে তারা। হেরে গেলে টাকা চলে গেল। আর জিতলে মূল টাকাসহ জুয়ার রেটের টাকা অ্যাকাউন্টে ফিরে আসে। পরে সেখান থেকে মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে টাকা তোলা যায়। কখনও স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমেও জুয়ার টাকা লেনদেন হয়।
জুয়ায় আসক্তদের নিয়ে চরম অশান্তিতে আছে পরিবারগুলো। টাকার জন্য জুয়াড়িরা স্বজন ও স্থানীয়দের কাছ থেকে ধারকর্জ করছে। এ টাকা পরিশোধ করতে না পারায় পরিবারকে হেনস্তার মুখে পড়তে হচ্ছে। চুরির মতো অপরাধেও জড়াচ্ছে জুয়াড়িরা। তবে সবাই হেরেই যাচ্ছে, এমন নয়। কেউ কেউ লাভও করছে। কিন্তু এ সংখ্যা হাতেগোনা।
অনলাইন বেটিংয়ে আসক্ত উপজেলার আল্লারদর্গা এলাকার বাসিন্দা কলেজ শিক্ষার্থী অনিক জানান, তিনি খেলা দেখার সময় বিজ্ঞাপন দেখে অনলাইন বেটিংয়ে আগ্রহী হন। লোভনীয় অফার দেখে একসময় আসক্ত হয়ে পড়েন। পড়ালেখা বাদ দিয়ে রাত জেগে বাজি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে গোপনে টাকা নিয়ে জুয়ায় বাজি ধরেছেন। প্রায় ৩ লাখ টাকা তিনি খুইয়েছেন। এ নিয়ে তাঁর পরিবারে অশান্তিও হয়েছে।
উপজেলার নলুয়া গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক বলেন, তাঁর ২১ বছর বয়সের নাতি অনলাইন জুয়ায় আসক্ত। নিজ বাড়ি থেকে জুয়ার টাকা জোগাতে না পেরে গত সপ্তাহে চাচার ঘর থেকে ২০ হাজার টাকা গোপনে নিয়ে যায়। পরে ১৫ হাজার টাকা তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। বাকি টাকা হেরেছে।
তারাগুনিয়া গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সোহেল রানা জানান, তিনি একটি ছোট ব্যবসা করে প্রতিদিন ১ হাজার টাকার মতো আয় করেন। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে তাঁর ভালোই চলছিল। অন্যের পরামর্শে অনলাইন বেটিংয়ে আসক্ত হয়ে তিনি ব্যবসার পুরো মূলধন হারিয়েছেন। ওই টাকা ফেরাতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও এনজিওর কাছ থেকে ১ লাখ টাকা ঋণ নিয়েও তা খুইয়েছেন। তিনি এখন নিঃস্ব।
মথুরাপুর গ্রামের ওমর ফারুক বলেন, তাঁর একমাত্র ছেলে কলেজে পড়ে। প্রায়ই মোবাইলে খেলা দেখে। পরে জানা গেল, অনলাইনে সে শুধু খেলাই দেখে না, জুয়াও খেলে। প্রথমে গোপনে সে পরিবারের জমানো টাকা চুরি করে নিয়ে জুয়া খেলেছে। পরে আত্মীয়স্বজন ছাড়াও গ্রামের মানুষের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে অনলাইনে খুইয়েছে। পাওনাদাররা এখন বাড়িতে এসে ঝামেলা করছে। এসব কারণে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে চরম অশান্তি তৈরি হয়েছে।
উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ও পিপলস ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ আবু সাঈদ মো. আজমল হোসেন বলেন, কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে এগুলো মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়বে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ছাড়াও গ্রামাঞ্চলের একেবারে নিম্ন পর্যায়ের মানুষও এতে জড়িয়ে পড়ছে। দ্রুত এসব সাইট বন্ধ করা দরকার। তা না হলে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে।
কুষ্টিয়া পুলিশের সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করেন ইন্সপেক্টর ওবাইদুর রহমান। তিনি বলেন, মোবাইলে হুমকি-ধমকি, প্রতারণা, লোকেশন ট্র্যাকিংয়ের মতো কাজ কুষ্টিয়া পুলিশের সাইবার ইউনিট করে থাকে। অনলাইনে কারা এসব বেটিং বা জুয়ায় জড়িত, তা শনাক্ত ও সাইটগুলো বন্ধের সক্ষমতা তাদের নেই। কোনো নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
- বিষয় :
- জুয়া