শহীদজননী জাহানার ইমাম স্মরণানুষ্ঠানে বক্তারা
প্রশাসনই দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে

জাতীয় জাদুঘরে ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক’ প্রদান করা হয়। ছবি-সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৪ | ২১:১১
প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে দুর্নীতি এখন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত আজিজ, বেনজীর, মতিউররা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। প্রশাসনই দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। দুর্নীতিবাজরা নির্বিঘ্নে দেশত্যাগের পর কেন তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়–তা তদন্ত করা প্রয়োজন। দুদকের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে কতটা সরে গেলে দেশে এমন পরিস্থিতি হয়–তা বোধগম্য হচ্ছে না।
বুধবার জাতীয় জাদুঘরে শহীদ জননী ‘জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতা’, আলোচনা সভা এবং ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক’ প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। শহীদ জননী ‘জাহানারা ইমামের ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এই অনুষ্ঠান আয়োজন করে। ‘বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন এবং ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা প্রদান করেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তবে তিনি জরুরি প্রয়োজনে রাজশাহীতে অবস্থান করায় তার পক্ষে ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল অনুষ্ঠানে লিখিত স্বারক বক্তৃতা পাঠ করেন। দীর্ঘ স্মারক বক্তৃতায় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু অস্ত্রের প্রতিযোগিতাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, বর্ণবৈষম্যকে ঘৃণা করেছেন, বিশ্বব্যাপী সম্পদের সুষম বণ্টনের উপর জোর দিয়েছেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়া, উপমহাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত, পুরো পৃথিবী নিয়ে ভেবেছেন।’
নির্মূল কমিটি’র সভাপতি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী নাগরিক আন্দোলনের পুরোগামী নেতা অধ্যাপিকা মাহফুজা খানম এবং সংগঠন হিসেবে ‘এম্পাওয়ারমেন্ট থ্রু ল অব দা কমন পিপল’ (এলকপ)-কে জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক প্রদান করা হয়।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আসিফ মুনীর তন্ময়ের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন, নির্মূল কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপিকা মাহফুজা খানম, এলকপ-এর সভাপতি অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, অ্যাডভোকেট এম সাঈদ আহমেদ রাজা। এর আগে সকালে মিরপুরে শহীদজননী জাহানারা ইমামের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ।
অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা যখন বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর চক্রান্ত শুরু করল। ঠিক সেই সময় আবির্ভূত হয়ে ছিলেন শহীদজননী। তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় গণআদালত। শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য তিনি যে মশাল জ্বালিয়ে ছিলেন, আমরা পরবর্তী প্রজন্ম সেটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাব।’
শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘বেনজীর–মতিউরের দুর্নীতি গণমাধ্যমই প্রকাশ করেছে, যার ভিত্তিতে অনেক আগেই বিভাগীয় তদন্ত আরম্ভ করা উচিৎ ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। তা না করে পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন যেভাবে গণমাধ্যমের সমালোচনা করেছে তার দায় সরকারের ওপরই পড়ে। অপরাধীরা ব্যাংকে সঞ্চিত যাবতীয় অর্থ নিয়ে নিরাপদে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাদের দেশ ছাড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, তাদের ব্যাংক লেনদেন বন্ধ করা হয়– এটা একটা তামাশায় পরিণত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দুদকও তাদের গাফেলতির দায় এড়াতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘কারা বেনজীর ও মতিউরের মতো ভয়ঙ্কর দুর্নীতিবাজদের নির্বিঘ্নে দেশত্যাগ করতে দিয়েছে এরও তদন্ত হওয়া দরকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিনাশী অপশক্তি বাংলাদেশকে ধ্বংস করার জন্য দেশে ও বিদেশে বহু ষড়যন্ত্র করছে। ষড়যন্ত্রকারীরা প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবস্থান করছে। এদের নির্মূল না করলে মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় অর্জন নস্যাৎ হয়ে যাবে।’
বিশ্ব শিক্ষক ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপিকা মাহফুজা খানম বলেন, ‘১৯৯২ সালে শহীদজননী জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যে সাহসী উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেই আন্দোলন আমরা এখনো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা যেরকম বাংলাদেশ চেয়েছিলাম এখনো তা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি।’
তিনি আরও বলেন, তরুণ প্রজন্ম আজ দুর্নীতিগ্রস্ত। টাকার পেছনে ছুটছে। বেনজীর–মতিউর প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতি করেছে। শুধু তাদের বিচার করলেই হবে না। তাদের পৃষ্ঠপোষকদেরও বিচার করতে হবে। শেখ হাসিনার একার পক্ষে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব হবে না। এর বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।’
সভাপতির বক্তৃতায় শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভালবাসা বাঙালির জন্য এবং বিশ্বের সকল শোষিত মানুষের জন্য দর্শন। ’৭৫-এর পর বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ছুড়ে ফেলেছিল স্বাধীনতাবিরোধীরা, কিন্তু সেই আদর্শকে বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।’
এদিকে বুধবার কবি সুফিয়া কামাল ও জাহানারা ইমাম স্মরণে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরও বিশেষ স্মরণানুষ্ঠান আয়োজন করে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখবেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ। অনুষ্ঠানে সুফিয়া কামাল ও জাহানারা ইমাম রচিত কবিতা ও চিঠি পাঠের পাশাপাশি সংগীত ও নৃত্য পরিবেশন করা হয়।
- বিষয় :
- জাহানারা ইমাম
- জাতীয় জাদুঘর
- দুর্নীতি
- আলোচনা সভা