বিচারে ধীরগতি সুযোগ নিচ্ছে দুর্নীতিবাজরা

কোলাজ
ওয়াকিল আহমেদ হিরন
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৪ | ০১:০৭
দুর্নীতির মামলা শুনানির জন্য ঢাকায় বিচারিকে ১৩ ও উচ্চ আদালতে রয়েছে এখতিয়ারভুক্ত ১০ বেঞ্চ। এখানে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে মামলা লড়ছেন যথাক্রমে ১১ ও ২৬ আইনজীবী। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই খণ্ডকালীন। ফলে যে হারে দুর্নীতির অভিযোগ, এরপর মামলা হচ্ছে; সে হারে এগোচ্ছে না বাকি প্রক্রিয়া। অবকাঠামোগত দুর্বলতার সুযোগই নিচ্ছেন দুর্নীতিবাজ, বিশেষ করে রাঘববোয়ালরা। তাদের আবেদন-নিবেদনে বছরের পর বছর বিচার কার্যক্রম থমকে থেকে জমছে মামলার পাহাড়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজ ও রাষ্ট্রে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা বিচারের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। বিচার প্রক্রিয়া চলমান থাকলে অপরাধীরা কিছুটা হলেও আইনের আওতায় থাকে। বিপরীতে বিচার ব্যাহত বা বিলম্ব হলে ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। বর্তমান দুর্নীতির মহোৎসব থামাতে সবার আগে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। পাশাপাশি বিশেষায়িত বেঞ্চ, পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ, সুপ্রিম কোর্টে বিচারক ও দুদকের নিজস্ব আইনজীবী বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে উচ্চ আদালতে ঝুলে রয়েছে চার হাজারের বেশি দুর্নীতি মামলার বিচার। সারাদেশে বিচারাধীন মামলা প্রায় তিন হাজার। এসব মামলার আসামি রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সরকারের সাবেক-বর্তমান উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্য। অবৈধ সম্পদ অর্জন, সম্পদের তথ্য ফাঁকি, উৎকোচ গ্রহণ, অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার, সরকারি ক্রয়ে দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে মামলা করেছে দুদক।
দুর্নীতির আলোচিত মামলা দিন দিন বাড়লেও নিষ্পত্তির হার খুবই কম। দুদক সূত্র জানায়, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ৫২৮ ও হাইকোর্ট বিভাগে ৩ হাজার ৫৭৬টি মামলা বিচারাধীন। এগুলোর মধ্যে রিট, ক্রিমিনাল মিস, ক্রিমিনাল আপিল ও ক্রিমিনাল রিভিশন রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারও সম্পদের হিসাব চাইলে তিনি হাইকোর্টে দুদকের নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। সেটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দুদক তাঁর বিষয়ে কার্যক্রম শুরুই করতে পারে না। এমন অসংখ্য মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন। তা ছাড়া বিচারিক আদালতে দুর্নীতি মামলায় সাজা হলে উচ্চ আদালতে আপিল শুনানির জন্য পেপারবুক তৈরি করতে হয়। রাষ্ট্রের পক্ষে দ্রুত এটি করা সম্ভব নয়। তবে আদালতের অনুমতি নিয়ে আসামি নিজ খরচে পেপারবুক তৈরি করতে পারেন। এ প্রক্রিয়াতেই আসামি সময়ক্ষেপণ করেন। আবার পেপারবুক তৈরির আগেই হাইকোর্ট থেকে জামিন পেলে তিনি এটি তৈরির ক্ষেত্রে গড়িমসি করেন। ফলে আপিল শুনানির জন্য হাইকোর্টে মামলা প্রস্তুত করতেই কেটে যায় পাঁচ-সাত বছর।
অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের আগস্টে রাজধানীর রমনা থানায় মামলা করে দুদক। ২০০৮ সালের জুনে এ মামলায় অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন বিচারিক আদালত। তবে আইনি জটিলতা দেখিয়ে এরপর ১৬ বছর পার করেছে আসামিপক্ষ। একইভাবে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৭ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগ নেতা হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় মামলা করে দুদক। ২০০৮ সালে বিচারিক আদালত তাঁকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেন। এরপর ২০২১ সালে হাইকোর্ট সাজা কমিয়ে ১০ বছর দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেন সেলিম, যা এখনও আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
বর্তমানে হাইকোর্টে আপিল শুনানির অপেক্ষায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল হারুন অর রশীদ, ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুন, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, ডেসটিনির রফিকুল আমীন, সাবেক এমপি ওয়াদুদ ভুঁইয়া, কক্সবাজারের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি, স্বাস্থ্যের আবদুল মালেক, যুবলীগ নেতা এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম, ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক ওরফে বাবুল চিশতী, এনামুল হক এনু ও রুপন ভুঁইয়া, হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামসহ অনেকের মামলা। আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে খালেদা জিয়া, আমানউল্লাহ আমান, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, হাফিজ ইব্রাহীমসহ অনেকের মামলা।
দুদকে তদন্তাধীন সাবেক এমপি কামরুল আশরাফ খান পোটন, পি কে হালদার, বেসিক ব্যাংকের শেখ আবদুল হাই বাচ্চু, বিকল্পধারার মেজর (অব.) আবদুল মান্নান, তরীকত ফেডারেশনের সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, সাবেক সচিব ড. প্রশান্ত কুমার রায়, মাদারীপুরের সাবেক এমপি সুব্রত কুমার হালদার, আপন জুয়েলার্সের মালিক গুলজার আহমেদ প্রমুখের অভিযোগ।
দুদকের তথ্যমতে, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে বিচারিক ও উচ্চ আদালতে দুদকের ৭ হাজার ১০৮টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ঢাকার আদালতে ৮৯৪ ও বাইরে অন্যান্য জেলায় রয়েছে ২ হাজার ১১০টি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিচারিক আদালতে ২০টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এতে ৫৬ জনের সাজা (৫৭ শতাংশ) ও খালাস পেয়েছেন ৩২। গত চার মাসে ঢাকায় ৫ ও বাইরে ১৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে; হার ৩ দশমিক শূন্য ৭। অন্যদিকে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত হাইকোর্টে ৩৩৫টি আপিল হয়েছে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ২০৬টি (হাইকোর্টে ১৮১ ও আপিল বিভাগে ২৫টি) মামলা; হার ৪ দশমিক ৭৮। এ সময়ে আপিল বিভাগে ১৯ ও হাইকোর্ট বিভাগে ৪২৬টি মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। অবশ্য এরপর মে ও জুন মাসে সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের অন্যান্য আদালতে আরও মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তি হয়েছে। এর বাইরে ২০০৪ সালে বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর করা ৩৫৪ মামলার মধ্যে চলমান ১৭৬ ও উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত রয়েছে ১৭৮টি।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, দুর্নীতির মামলায় কারও সাজা হলে রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন তিনি। হাইকোর্টে পর্যাপ্ত বেঞ্চ না থাকায় এসব আপিল ঝুলে থাকে।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানায়, হাইকোর্টে দুর্নীতি মামলা শুনানির জন্য আলাদা কোনো বেঞ্চ নেই। ১০টি বেঞ্চের ক্রিমিনাল মামলার পাশাপাশি দুর্নীতি মামলা শুনানির এখতিয়ার রয়েছে। দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির জন্য দুদকের ২৬ আইনজীবীর প্যানেল এখানে কাজ করে। কিন্তু তিন-চার বেঞ্চে আসামিপক্ষ বেশি যায়। ফলে আপিল নিষ্পত্তিতে দেরি হয়। এ ছাড়া ঢাকা জজকোর্টে পৃথক ১৩টি বেঞ্চে দুর্নীতির মামলা শুনানি হয় এবং সেখানে দুদকের ১১ আইনজীবী মামলা পরিচালনা করেন। ঢাকার আদালতে বর্তমানে বিচারাধীন হাজারখানেক মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছেন পিপি জাহাঙ্গীর হোসেন দুলাল।
যা বললেন আইন বিশেষজ্ঞরা
দুর্নীতির মামলা থমকে থাকার বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, স্থায়ী আইনজীবী ক্যাডার না থাকায় সরকারের মামলাগুলো যতটা ভালোভাবে সম্পন্ন হওয়ার কথা, তা হচ্ছে না। দুদকের পক্ষে এখন ২৫-২৬ আইনজীবী দিয়ে চার হাজার মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়। আমাদের আইন ও বিচার ব্যবস্থায় বাজেটে অর্থ বরাদ্দ খুবই কম। আইনজীবী ক্যাডার তৈরি, আইন মন্ত্রণালয়ে অর্থ বরাদ্দ, সুপ্রিম কোর্টে বিচারক ও বেঞ্চ এবং দুদকের নিজস্ব আইনজীবী বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সভাপতি জেড আই খান পান্না বলেন, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আদালতে অসংখ্য মামলা পড়ে আছে। কিন্তু বিচারে রাঘবোয়াল কারও শাস্তি দেখছি না। বিচার বিলম্বিত হওয়ায় দুর্নীতিবাজরা আরও বেপরোয়া। দুর্নীতি মামলায় বিচারের গতি না বাড়লে জনগণের কাছে বিচার বিভাগের দুর্বলতা প্রতীয়মান হবে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে দুর্নীতিবাজদের বিচারের মুখোমুখি ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ যেন উৎসাহী হয়ে প্রয়োজন বোধ করেন, সেটিই আমাদের প্রত্যাশা।
দুর্নীতির মামলায় ধীরগতি নেই মন্তব্য করে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সমকালকে জানান, উচ্চ আদালতে দুর্নীতির মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন। দুর্নীতির মামলা হাইকোর্টে আসার পর সেখানে দুদকের সঙ্গে পক্ষভুক্ত থাকে রাষ্ট্র। দুদক সহায়তা চাইলে তা দেওয়া হয়। দুর্নীতির মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করতে যথেষ্ট নথি দরকার হয়। সরকার দীর্ঘদিনের পুরোনো দুর্নীতির মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির চেষ্টা করছে বলে জানান তিনি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আদালতের বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা পুরোনো রোগ। হাজার হাজার মামলা বিচারাধীন রেখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ফাঁকা বুলি ছোড়া হচ্ছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে আমরা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ কিংবা আদালতে সাজার রায় দেখতে পাচ্ছি না। চুনোপুঁটি টানাটানি না করে রাঘববোয়ালদের আইনের মাধ্যমে ধরতে হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু আলোচিত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি ও দৃষ্টান্তমূলক সাজা হলে তা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ভালো বার্তা বয়ে আনবে।
দুদকের প্রধান কৌঁসুলি খুরশীদ আলম খান সমকালকে বলেন, বর্তমানে দুর্নীতি বাড়লেও দুদকের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পায়নি। মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তার ঘাটতি রয়েছে। অথচ একটি মামলার কার্যকর ফলাফল পেতে দক্ষ পিপি প্রয়োজন। তিনি বলেন, বিচারিক আদালতে দুর্নীতি মামলার সাজা বাড়লেও হাইকোর্টে আপিল নিষ্পত্তিতে দেরি হচ্ছে। চোখে লাগার মতো অনেক মামলা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। হাইকোর্টে দুদকের মামলার আপিল শুনানির জন্য আলাদা বেঞ্চ গঠন ছাড়া সহসা এসব সংকট কাটবে না।
- বিষয় :
- দুর্নীতিবাজ
- বিচার বিভাগ