ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

ইআরএফের আলোচনায় আহসান এইচ মনসুর

এখন টাকা নেই ডলারও নেই

ব্যাংক খাত নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে

এখন টাকা নেই ডলারও নেই

আহসান এইচ মনসুর

 বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৪ | ০১:৩২

আর্থিক খাত সবচেয়ে স্বচ্ছ থাকার কথা। অথচ সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে চলছে ব্যাংক খাত। ২৫ শতাংশের মতো খেলাপি ঋণ থাকলেও দেখানো হচ্ছে ১০ শতাংশ। এভাবে অস্বচ্ছতার মাধ্যমে কার্পেটের নিচে ময়লা রেখে সমস্যা জিইয়ে রাখা হচ্ছে। এখন টাকা নেই, ডলারও নেই। ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা কাটাতে ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করা দরকার। একই সঙ্গে সরকারের দিক থেকে একটা বড় ধরনের শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংককেও দায়বদ্ধ করতে হবে। গতকাল শনিবার এক আলোচনায় গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এসব কথা বলেন।

গতকাল অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ‘বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থার কারণ’ শীর্ষক এ আলোচনার আয়োজন করে। রাজধানীর পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মীরধা। সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে ব্যাংক খাতের বর্তমান অবস্থার ওপর একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি ওবায়দুল্লাহ রনি ও প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সানাউল্লাহ সাকিব।

আহসান মনসুর বলেন, ‘উইন্ডো ড্রেসিং’ করে অস্বচ্ছতার মাধ্যমে কার্পেটের নিচে ময়লা ঢেকে রাখা যাবে। তবে ময়লা তো ঘরেই আছে। ফলে দুর্গন্ধ ছড়াবেই। ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধান না করে জিইয়ে রাখা হয়েছে। সমাধানের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। সমাধান করতে লাখ লাখ কোটি টাকা লাগবে। তিনি বলেন, নির্বাচনের পর ব্যাংক খাতসহ অনেক ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল। নির্বাচন হয়েছে ছয় মাস হয়েছে। তবে সংস্কারের কিছুই দেখা গেল না। মাঝে ব্যাংক একীভূতকরণের একটা আলোচনা হলেও যেভাবে করা হচ্ছিল, তা সঠিক ছিল না। ফলে সেই আলোচনাও মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, এভাবেই কি দেশ চলবে?

আইএমএফের সাবেক এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। সংস্কার হতে হবে আর্থিক খাতে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনায়, স্বাস্থ্য খাতে, প্রশাসনিক ব্যয়সহ সব জায়গায়। বাজেটের ৪২ শতাংশ প্রশাসনিক ব্যয়ে চলে যাচ্ছে। একজন ইউএনওর জন্য পাঁচজন পুলিশ থাকে। আর নরওয়ের মতো ধনী দেশের প্রেসিডেন্ট সাইকেল চালিয়ে অফিস করেন। তাদের মেয়াদ শেষ হলে সাইকেল চালিয়ে বিদায় নেন। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশের মতো ব্যয় করে। আর থাইল্যান্ড করে ৬ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র করে ১৭ শতাংশ। এসব দেশে কারও ক্যান্সারের মতো রোগ হলেও নিঃস্ব হয়ে যেতে হয় না।

টাকা ছাপিয়ে অচল ব্যাংক সচল রাখার দরকার নেই
আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রশ্ন উঠেছে ইসলামী ব্যাংকের তারল্য সংকট রয়েছে, অথচ ভালো মুনাফা করল কীভাবে। ঋণের বিপরীতে এ মুনাফা দেখানো হয়েছে। অথচ দেখা যাবে যার ভিত্তিতে হিসাব করেছে, সেই ঋণেরই অস্তিত্ব নেই। এভাবে আমানতকারীর টাকা খেয়ে ফেলা হয়েছে। আমানত খেয়ে কোনো ব্যাংক চললে কোথায় দাঁড়াতে পারে, বুঝতে হবে। কেউ যদি ঘরের থালা-বাসন বিক্রি করে পোলাও-কোরমা খায়, কত দিন খেতে পারবে ভাবতে হবে।

তিনি বলেন, টাকা ছাপিয়ে অচল ব্যাংক সচল রাখার দরকার নেই। আবার রেমিট্যান্সে প্রণোদনা বন্ধ করতে হবে। তা না হলে মূল্যস্ফীতি কমবে না। ডলারের দর বাজারভিত্তিক হয়েছে, সুদহার বেড়েছে। ফলে এখন আর প্রণোদনার দরকার নেই। ইসলামী ব্যাংকগুলো উদ্ধারের নামে যদি টাকা ছাপানো অব্যাহত থাকে, তাতে মূল্যস্ফীতি কমবে না। এ ছাড়া ধার করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাময়িক বাড়ানো যাবে। তবে তা স্থায়ী সমাধান নয়। সঠিক নীতির মাধ্যমে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়িয়ে রিজার্ভ বাড়াতে হবে। তা না হলে ১৩ বিলিয়ন রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে ৪০০ বিলিয়ন জিডিপির দেশ ঠিক রাখা যাবে না।

ব্যাংকের কারণে সরকারও বিপদে পড়ছে
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকিং খাতে নিম্নমুখী প্রবণতার কারণে শুধু সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমন নয়। সরকারও এ কারণে বিপদে পড়ছে। এখন বাজেটে সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে অর্থায়ন। এমনিতেই সরকারের কর-জিডিপি ১১ শতাংশ থেকে কমে সাড়ে ৭ শতাংশে নেমেছে। আবার সাড়ে ৪ শতাংশ বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা উচ্চ হারে সুদ দিয়েও ঋণ পাচ্ছেন না। অর্থ বাইরে চলে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এখন টাকা নেই, ডলারও নেই। সব মিলিয়ে সরকার অর্থায়ন করতে পারছে না। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে যে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ধারের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে, তা নিতে পারবে না। কেননা, এবার যদি ব্যাংক খাতের আমানত ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়, তার পরও বাড়বে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। ফলে এত অর্থ সরকার নিলে বেসরকারি খাত কোথায় পাবে।
 
সুশাসনের সঙ্গে জড়িত
আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারের শাসন ব্যবস্থার গুণগত মানের সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের সূচকের ভালো-মন্দ সরাসরি জড়িত। সরকারের নীতিনির্ধারণের শাসন কাঠামো যখন পরিবর্তন হয়, তখন কেবল ব্যাংকিং খাত নয়, অনেক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দুর্বল হয়ে পড়ে। ব্যাংকিং খাতের সূচকের ধারাবাহিকতা দেখলে তা পরিষ্কার বোঝা যায়। ১৯৯২-৯৩ থেকে ২০১০-১১ সাল পর্যন্ত এ খাতের ধারাবাহিক উন্নতি হয়েছে। এর পর আবার ধারাবাহিক নিম্নমুখী হয়েছে। সুশাসন ঘাটতির মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে ঘুণে ধরেছে। 
তিনি বলেন, আর্থিক খাতের চারটি উপাদান– ব্যাংক, শেয়ারবাজার, বন্ড মার্কেট ও বীমা। দেশের বন্ড মার্কেট কখনও ভালো ছিল না। বাকি তিনটিতে সংখ্যার দিক দিয়ে ভালো দেখালেও মানে ভালো নেই। আর্থিক খাত ঊর্ধ্বমুখী করার ব্যাপারে দেশ হিসেবে শোচনীয়ভাবে পরাজয় হয়েছে। ঊর্ধ্বমুখী করার পরিবর্তে গত ১০ থেকে ১৫ বছরে নিম্নমুখী হয়েছে।

সবচেয়ে উল্টাপাল্টা তথ্য ব্যাংক খাতে
আহসান এইচ মনসুর বলেন, রপ্তানির তথ্যে উল্টাপাল্টা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। তবে সবচেয়ে উল্টাপাল্টা ব্যাংকিং খাতের তথ্যে। এখানে ২০ শতাংশ; অথচ ব্যাংকে তো ৪০০ শতাংশ তথ্য লুকানো আছে। খেলাপি ঋণ বলা হচ্ছে ১০ শতাংশ। আসলে তো ২৫ শতাংশের মতো খেলাপি। অথচ আর্থিক খাত সবচেয়ে স্বচ্ছ হওয়ার কথা। 

কৃষি খাতের তথ্যের সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন
আহসান এইচ মনসুর বলেন, কৃষি খাতের প্রতিটি তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। বছরে ৩ লাখ ৬০ হাজার টন চালের উৎপাদন দেখানো হচ্ছে। তার পর আরও চাল আমদানি হচ্ছে। সফলতা দেখানোর জন্য প্রতিবছর আগের চেয়ে একটু করে বাড়িয়ে দেখানো হয়। সরকারি তথ্যের সঙ্গে প্রকৃত তথ্য ও বাজারের মিল পাওয়া যায় না। এখন মাছ উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। তবে মাছের দাম তো কমেনি। ইলিশে সর্বোচ্চ উৎপাদন বাংলাদেশ। অথচ সেই মাছ কোথায়, কে খাচ্ছে? সেটা যাচ্ছে কোথায়? এর মানে তথ্যের সঙ্গে বাজারের বড় পার্থক্য রয়েছে। ফলে শুধু তথ্য উৎপাদন করলে হবে না, পণ্য উৎপাদন করতে হবে। 


 

আরও পড়ুন

×