ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ঘুরছে না কারখানার চাকা রপ্তানিতে অশনিসংকেত

ঘুরছে না কারখানার চাকা রপ্তানিতে অশনিসংকেত

আমদানি-রপ্তানিতে অচলাবস্থার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার জট। সোমবার তোলা মো. রাশেদ

 সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম ও আবু হেনা মুহিব, ঢাকা

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৪ | ২২:৩০ | আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২৪ | ২২:৩১

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে কারফিউ জারির পটভূমিতে প্রায় সব শিল্প কারখানার উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে বেশি বেকায়দায় পড়েছে রপ্তানি খাত। সংকটের আগে উৎপাদিত রপ্তানি পণ্য ব্র্যান্ড-ক্রেতারা নিতে না পারায় সেগুলো কারখানা কিংবা বন্দরে পড়ে আছে। 

পরিবহন সচল থাকার সময় চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানো রপ্তানি পণ্যও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় শিপমেন্ট করা যাচ্ছে না। একই কারণে শিল্পের জন্য আমদানি করা কাঁচামালও বন্দর থেকে হচ্ছে না ছাড়। এতে শুধু তৈরি পোশাক খাতেই দিনে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে অন্তত এক হাজার ৬০০ কোটি টাকার। আর্থিক এ ক্ষতির বাইরে দেশের ভাবমূর্তির সংকটকে বড় ক্ষতি হিসেবে দেখছেন উদ্যোক্তারা। রপ্তানিকারকরা বলছেন, ব্র্যান্ড-ক্রেতারা নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে থাকলে তারা এ দেশ থেকে রপ্তানি আদেশ বিকল্প দেশে সরিয়ে নিতে পারেন। যার পরিণতি হবে ভয়াবহ। 

এ পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় গতকাল সোমবার রাতে জরুরি বৈঠকে বসেন পোশাক খাতের রপ্তানিকারক দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা। সেখানে কারখানা খোলার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। জানতে চাইলে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সমকালকে বলেন, বৈঠকে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। তবে খুলে দেওয়ার মতো অবস্থা তৈরি না হওয়ায় মঙ্গলবারও কারখানা সচল হচ্ছে না। আজ সন্ধ্যায় আমরা আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসব। আশা করছি, বুধবার থেকে কারখানা খোলার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মতবিনিময় সভায়ও ব্যবসায়ী নেতারা কারখানা খুলে দেওয়ার বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা চান।

রপ্তানিপ্রবণতা বিশ্লেষণে দেখা যায়, পোশাক খাতে গড়ে প্রতি মাসে ৪৫০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে। এ হিসাবে প্রতিদিন রপ্তানির পরিমাণ ১৫ কোটি ডলার বা এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা। গত শনিবার থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ড এবং খুচরা ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি আদেশের এসব পণ্য প্রস্তুত হওয়ার পর হয় কারখানায়, না হয় চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে আছে। কবে এসব পণ্যের শিপমেন্ট হবে তা বলা যাচ্ছে না। কারণ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে ক্রেতার হাতে পণ্য পৌঁছানো কঠিন হবে। শেষ পর্যন্ত এসব পণ্য স্টকলটের (ব্র্যান্ড-ক্রেতার দেওয়া রপ্তানি আদেশ বাতিল) শিকার হতে পারে। ফলে উৎপাদন খরচের চেয়ে নামমাত্র দামে স্থানীয় বাজারেই এসব পণ্য ছেড়ে দিতে হবে।

 কোনো কোনো ক্রেতা এসব পণ্য নিলেও চুক্তির চেয়ে কম দর দেওয়া বা দেরিতে মূল্য পরিশোধ করতে চাইবে। 
পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় আগে থেকে বন্দরে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ আছে। কারফিউ জারির আগেই বন্দরে পৌঁছানো পণ্য শিপমেন্ট বা জাহাজীকরণ বন্ধ। আমদানি করা শিল্পের কাঁচামালও বন্দর থেকে ছাড় হচ্ছে না। তৈরি পোশাক উৎপাদন করতে স্থানীয় বিভিন্ন অ্যাক্সেসরিজ আনা-নেওয়াও বন্ধ। এ পরিস্থিতির জের রপ্তানি খাতে অনেক দিন থেকে যেতে পারে।
গাজীপুরের বাঘের বাজারে একটি শিল্প গ্রুপের ১৪টি ব্র্যান্ড-ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি আদেশের পণ্য তৈরি হয়ে পড়ে আছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যভিত্তিক নেক্সট এবং মেটালনের মতো ব্র্যান্ডও রয়েছে। জানতে চাইলে ওই গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে জানান, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী উৎপাদিত পণ্যের মূল্য ৮ লাখ ডলার। ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হওয়ার পরই রপ্তানির জন্য প্রস্তুত এসব পণ্য নিয়ে বেকায়দায় আছেন তারা। ক্রেতাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করছেন। ক্রেতা প্রতিনিধিরা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পরামর্শ দিয়েছেন। মহাব্যবস্থাপক বলেন, কয়েক বছর ধরে ব্র্যান্ড-ক্রেতাদের সঙ্গে সব যোগাযোগ এখন অনলাইনভিত্তিক। এর বাইরে অন্য মাধ্যমে সঠিকভাবে যোগাযোগও করা যায় না। রপ্তানিতে এ অচলাবস্থায় আগামী মাসের শুরুতে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ নিয়ে বড় ধরনের অসন্তোষের শঙ্কা করছেন তারা।

বাংলাদেশের পোশাকের অন্যতম ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ঢাকার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে জানান, তাদের ৫০ কোটি ডলারের পণ্য আটকা পড়েছে। এর মধ্যে কিছু পণ্য কারখানা থেকে বের করা যায়নি। কিছু পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে আনার পর আটকা পড়েছে।

দিনে ক্ষতি ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা 
কারখানা বন্ধ থাকায় পোশাক খাতে প্রতিদিন ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির কথা জানিয়েছে রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ। আর্থিক এ ক্ষতির চেয়েও বড় ক্ষতি ভাবমূর্তি। বিদেশি ব্র্যান্ড-ক্রেতার কাছে আস্থার যে সংকট তৈরি হয়েছে, সে ক্ষতি টাকার অঙ্কে প্রকাশযোগ্য নয়। গতকাল সোমবার বিজিএমইএর এক বিবৃতিতে এ শঙ্কার কথা জানানো হয়। 
বিবৃতিতে বিজিএমইএ সভাপতি এস এম মান্নান কচি বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরকার সচেষ্ট রয়েছে। সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে গত শনিবার থেকে গতকাল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কারখানা এলাকার পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। 

চট্টগ্রাম বন্দরে নজিরবিহীন সংকট
দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে ভয়াবহ জট লেগেছে চট্টগ্রাম বন্দরে। শুল্কায়নের সব প্রক্রিয়া আগে শেষ হওয়ার পরও আউট পাস না পাওয়ায় বন্দর থেকে খালাস করা যাচ্ছে না আমদানি পণ্যবোঝাই প্রায় ৩ হাজার কনটেইনার। প্রতিদিন ২০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করা চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজও এক রকম স্থবির হয়ে আছে। পণ্য বন্দরে আসার পরও সার্ভার কাজ না করায় নথিভুক্ত করা যাচ্ছে না আমদানি-রপ্তানির ২০ হাজার চালান। 

টানা কারফিউর কারণে ডিপোতেও আসতে পারছে না রপ্তানি কনটেইনার। প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজার রপ্তানি কনটেইনার আসত ডিপোতে। এখন সেটি নেমেছে শূন্যের কোঠায়। গত তিন দিনে নতুন কোনো রপ্তানি কনটেইনার শুল্কায়নও হয়নি ১৯ ডিপোর কোথাও।

এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, প্রধান সমুদ্রবন্দর ও সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায় করা কাস্টম হাউস আগে কখনও এমন সংকটে পড়েনি। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করা না গেলে অপূরণীয় ক্ষতির মুখোমুখি হবেন ব্যবসায়ীরা। 

জানা গেছে, শুল্কায়ন প্রক্রিয়া শেষ করার পরও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে আউটপাস পাচ্ছেন না আমদানিকারকরা। এ জন্য গাড়িতে পণ্য বোঝাই করার পরও তা বন্দর জেটি থেকে বের করা যাচ্ছে না। এ রকম প্রায় তিন হাজার কনটেইনার পণ্য আছে বন্দরে। এর মধ্যে রয়েছে ভোগ্যপণ্যও। পচনশীল পণ্য ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে শুল্কায়ন করলেও অন্য পণ্যগুলোর ব্যাপারে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। 

চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান বলেন, ইন্টারনেট না থাকায় এনবিআরের সার্ভারে আমদানি-রপ্তানি চালান নথিভুক্ত করা যাচ্ছে না। আউটপাসও দিতে পারছি না। 
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সহকারী কমিশনার (গেট শাখা) প্রদীপ দাশ জানান, ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি খোলা পণ্য, যেমন– ফ্লাই অ্যাশ, সার, ক্লিংকার, মাছ, ফলমূল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা জাতীয় পণ্য তারা ম্যানুয়ালি শুল্কায়ন করে খালাসের অনুমতি দিচ্ছেন। শিল্পের কাঁচামালও সরাসরি খালাস করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তার পরও কমানো যাচ্ছে না জট। কারণ স্বাভাবিকভাবে পিসিটি ছাড়া বন্দরের ১০টি গেট দিয়ে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার কনটেইনারের গেট পাস ইস্যু করেন তারা। এখন ম্যানুয়ালি যা করা হচ্ছে, তা মোট পণ্যের মাত্র ১ শতাংশ হবে বলে জানান তিনি। তাই ৯৯ শতাংশ পণ্য এখন পড়ে থাকছে বন্দরে। প্রতিদিন এই সংখ্যা বাড়ছে। কারণ জেটিতে প্রতিদিনই নোঙর করছে নতুন জাহাজ। সেসব জাহাজ থেকে নামছে পণ্যও। ডেলিভারি পয়েন্টে তা আটকে থাকায় তৈরি হচ্ছে জট।

কাস্টমসে নথিভুক্ত করা যায়নি ২০ হাজার চালান
চট্টগ্রাম বন্দরে আসা পণ্য শুল্কায়নের জন্য নথিভুক্ত করতে হয় কাস্টম হাউসে। দাখিল করতে হয় আমদানি-রপ্তানি নথি। প্রতিদিন এমন নথি সার্ভারে যুক্ত করা হয় গড়ে প্রায় ছয় থেকে সাত হাজার। তিন দিন ধরে কোনো নথিই সার্ভারে যুক্ত করতে পারেনি কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। হয়নি শুল্কায়নও। এই তিন দিনে প্রায় ২০ হাজার আমদানি-রপ্তানি নথির জট লেগেছে কাস্টমসে। আগে যেসব নথির শুল্কায়ন করা হয়েছে, সেগুলোরও ছাড়পত্র দিতে পারছে না তারা। 

সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, রোববার দুপুরের পর থেকে ম্যানুয়ালি কিছু পণ্যের শুল্কায়ন হচ্ছে। এটি প্রয়োজনের তুলনায় কম। ইন্টারনেট দ্রুত না পেলে বিপর্যয় নেমে আসবে বন্দর কাস্টমসে।

কনটেইনার ডিপোতে স্থবিরতা
৩৭ ধরনের আমদানি পণ্য ও শতভাগ রপ্তানি পণ্যের শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় ১৯টি বেসরকারি ডিপোতে। প্রতিদিন গড়ে ২৫০ রপ্তানি কনটেইনার আসে এসব ডিপোতে। গত রোববার মাত্র ১৬টি কনটেইনার আসে ডিপোতে। ১৯ ডিপো থেকে প্রতিদিন বন্দরে যায় ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ২০০ রপ্তানি কনটেইনার। গতকাল সোমবার গেছে মাত্র ৭০০-৮০০ কনটেইনার। এসব কনটেইনারের যাবতীয় কার্যক্রমও আগে সম্পন্ন করা ছিল। ১৯ ডিপোতে প্রতিদিন গড়ে চার হাজার কনটেইনার ভর্তি কাভার্ডভ্যান আসে। এখন সেটি নেমে এসেছে ৫০-৬০টিতে। 
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের সচিব রুহুল আমিন শিকদার বলেন, ডিপোতে আমদানি-রপ্তানির সব কার্যক্রম স্থবির হওয়ার পথে। এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে ভয়াবহ ক্ষতির মুখোমুখি হবেন ব্যবসায়ীরা।


 

আরও পড়ুন

×