অর্থ মন্ত্রণালয়ে কী মধু

কোলাজ
সাব্বির নেওয়াজ
প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:৪০ | আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৪ | ১২:১০
অর্থ মন্ত্রণালয়ে একবার বদলি হয়ে এলে আর সরতে চান না কর্মকর্তাদের অনেকেই। এই মন্ত্রণালয়ে বদলি না হওয়া অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়েছে বলে প্রশাসনে আলোচনা রয়েছে। ক্ষমতা ও খুঁটির জোরে কর্মকর্তারা বছরের পর বছর একই বিভাগে কাটিয়ে দিচ্ছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বদলি হয় এক উইং থেকে অন্য উইংয়ে। এ নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই।
সরকারি চাকরিতে সর্বোচ্চ তিন বছর এক কর্মস্থলে থাকার বিধান রয়েছে। এ সময় অতিক্রম হলে অন্যত্র বদলি করা হয়। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিত্র যেন ভিন্ন। টানা এক যুগের বেশি সময় মন্ত্রণালয় ছাড়তে হয়নি এমন কর্মকর্তাও আছেন। ৫ বছরের বেশি সময় ধরে চাকরি করছেন প্রায় অর্ধশত কর্মকর্তা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার এ ধরনের সুবিধাবাদী কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পায় না। তারা পুরাতন চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা নিয়েই দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। দীর্ঘদিন এক স্থানে থাকার কারণে দুর্নীতির সুযোগ বাড়ে। তাই জনস্বার্থে বদলি করা বাঞ্ছনীয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেন, দ্রুত পদোন্নতি, যানবাহন সুবিধা ও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে এই মন্ত্রণালয়ে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের বাজেট-১ শাখার অতিরিক্ত সচিব সিরাজুন নূর চৌধুরী টানা সাড়ে ৯ বছর ধরে এই মন্ত্রণালয়ে কর্মরত। এই মন্ত্রণালয়ে ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেয়ে তিনি অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন। অভ্যন্তরীণ পদায়ন, বিদেশ প্রশিক্ষণ ও প্রকল্প কর্মকর্তা নিয়োগের দায়িত্বে আছেন তিনি। এ কারণে মন্ত্রণালয়ের সবাই তাঁকে সমীহ করেন। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরই পদত্যাগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি অর্থ সচিব থাকার সময় তাঁর সবচেয়ে আস্থাভাজন কর্মকর্তা ছিলেন সিরাজুন নূর। সাবেক সরকারের আমলে তাঁর দাপট ছিল এ মন্ত্রণালয়ে সবার চেয়ে বেশি। সরকার পতনের পরও তিনি বহাল তবিয়তে আছেন। এ নিয়ে অনেক কর্মকর্তার মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।
আরেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান টানা প্রায় সাড়ে ৯ বছর অর্থ বিভাগে কাটিয়ে দিচ্ছেন। গত সরকারের সময়ে অর্থমন্ত্রী, অর্থ সচিব ও গভর্নরের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে তিনিও পরিচিত। ছিলেন আওয়ামী লীগ আমলে জেলা প্রশাসকও। এখানে পদায়নের পর আর কোথাও বদলি হননি তিনি। নতুন সরকারের দেড় মাসের মধ্যেই তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অতি আস্থাভাজন হওয়ার জন্য সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন বলে মন্ত্রণালয়ে প্রচার রয়েছে।
শুধু এই দুই কর্মকর্তা নন, ১১ বছরের বেশি সময় ধরে এখানে রয়েছেন দুই যুগ্ম সচিব রওনক জাহান ও তনিমা তাসনিম। দু’জনই সাবেক অর্থ মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এ মন্ত্রণালয়ে ৫ বছরের বেশি সময় ধরে চাকরি করছেন প্রায় অর্ধশত কর্মকর্তা। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন, কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগে কারিগরি বা টেকনিক্যাল অথবা তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত ইস্যু থাকলে এসবের প্রয়োজনে দুয়েকজন বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাকে স্বপদে বহাল রাখা যেতে পারে। তবে ঢালাও বদলি না হওয়া অবাঞ্ছনীয়। তারা স্বপদে থাকার কারণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ক্ষেত্রে দুর্নীতির সুযোগ বাড়ে। তিনি বলেন, একটা সময় পর বদলি করা উচিত। না হলে ওই কর্মকর্তার কাছ থেকে নতুন পরিকল্পনা বা সার্ভিস আশা করা যায় না। পুরাতন চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা নিয়েই দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এতে সরকার ওই কর্মকর্তার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পায় না। তাই জনস্বার্থে বদলি করা বাঞ্ছনীয়।
জানা গেছে, এই মন্ত্রণালয়ে বদলি না হওয়া অনেকটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে বলে প্রশাসনে আলোচনা রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেন, সহসা পদোন্নতি, যানবাহন সুবিধা ও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে এখানে। যারা মন্ত্রী ও সচিব থাকেন, তারা পদোন্নতি ও পদায়নে নিয়ামক হিসেবে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। তাদের আশপাশে অবস্থান করে কোনো কোনো কর্মকর্তা সুবিধা নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। যে কোনো উপায়ে তারা এক কর্মস্থলেই থাকেন বছরের পর বছর। এ জন্য কেউ কেউ অর্থ বিনিয়োগ করতেও দ্বিধা করেন না। এদিকে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার জন্য অনেকেই অর্থ মন্ত্রণালয়ে পদায়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ করেন।
বদলি না হওয়া আমলাদের খুঁটির জোর অনেক বেশি বলে জানা গেছে। তাদের ছায়া দেন প্রভাবশালী সাবেক-বর্তমান আমলা ও রাজনীতিকরা। প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করেই চলে নানা অনিয়ম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনপ্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দু’মাস হতে যাচ্ছে। তবে তারা পুরোপুরি প্রশাসনিক সংস্কার আনতে পারেনি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুগতদের বেশির ভাগ এখনও এই মন্ত্রণালয়ে কর্মরত। বদলি নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হলেই সতর্ক হয়ে যান পদ আঁকড়ে থাকা কর্মকর্তারা। পুরোনো কৌশলেই তারা ধরনা দিচ্ছেন নতুন সরকারের ঘনিষ্ঠদের কাছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সদ্য পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন বেগম নাসরিন সুলতানা। এক-এগারোর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বদলি হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগে যোগদান করেছিলেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পুরো সময় ছিলেন এ বিভাগে। ১৭ বছর দুই মাস এ বিভাগেই থাকা নাসরিন সুলতানা অবসরে যাবেন ৯ মাস পর। অভিযোগ উঠেছে, এখানে টিকে থাকতে তিনি চালাচ্ছেন লবিং-গ্রুপিং।
কর্মকর্তাদের মধ্যে ১২ বছর ৭ মাস ধরে অর্থ বিভাগে আছেন সুলেখা রাণী বসু। আবুল মনসুর রয়েছেন ১০ বছর ১ মাস, ড. মো. মতিউর রহমান ১০ বছর, বিলকিস জাহান রিমি ৯ বছর ১০ মাস, মুন্সী আবদুল আহাদ ৮ বছর ১১ মাস, মনজুরুল হক ও নজরুল ইসলাম ৯ বছর ধরে আছেন। দিল আফরোজ, মুহাম্মদ আনিসুর রহমান ও মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান আছেন ৮ বছর ধরে। ৭ বছর ধরে অর্থ বিভাগে রয়েছেন ড. আবদুর রহিম, সৈয়দ মুহাম্মদ।
- বিষয় :
- অর্থ আদায়
- অর্থ মন্ত্রণালয়
- টাকা