দারিদ্র্য-ঝুঁকি এখন নগরমুখী

প্রতীকী ছবি
আবু হেনা মুহিব
প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৪ | ০২:১২ | আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২৪ | ০৪:০৩
আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের একটি পোশাক কারখানার অপারেটর পদের শ্রমিক মমতা আক্তারের মাসিক মজুরি সাকল্যে ১৩ হাজার টাকা। সেপ্টেম্বর মাসের ১৮ দিনের মজুরি পাননি তিনি। ‘বড় ভাই’দের আন্দোলনের কারণে এই ১৮ দিন কারখানা বন্ধ ছিল।
এ ক’দিনের যে মজুরি তারা পাবেন না, তা আগেই জানিয়েছিলেন ফ্লোর সুপারভাইজার। ফলে কেটেছিঁড়ে হাতে এসেছে ৫ হাজার ২০০ টাকা। এর মধ্যে ৪ হাজার টাকা গেছে ঘর ভাড়ায়। বাকি ১ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে পার করতে হবে পুরো মাস। তাই স্বামীহারা মমতা চোখে শর্ষে ফুল দেখছেন।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাজার বলতে কাঁচা পেঁপে আর আলু। এ দুই তরকারিই ৫০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। এভাবে আর কত। দুধকুমার নদের ভাঙনে বসতভিটা হারানো কুড়িগ্রামের উলিপুর থেকে শহরে এসেছেন মমতা। কিন্তু এখানেও তাঁর রক্ষা নেই।
এ গল্প শুধু মমতার নয়, তাঁর মতো নিঃশ্ব হওয়া হাজারো মানুষের। জলবায়ুর অভিঘাতে নদীভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে মমতাদের মতো শহরমুখী মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এ কারণে বাংলাদেশের দারিদ্র্যও এখন শহরমুখী। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনেও। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গ্রামে ২০১০ সালে দারিদ্র্য ছিল ৪১ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৬ সালে তা ২৯ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসে। ২০২২ সালে গ্রামীণ দারিদ্র্য দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে।
অন্যদিকে শহরে ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৬ সালে ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ ও ২০২২ সালে তা ১৪ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ প্রথম ছয় বছরে গ্রামের দারিদ্র্য কমছে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে। পরের ছয় বছরে কমেছে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ হারে। প্রথম ছয় বছর আর শেষ ছয় বছরের মধ্যে দারিদ্র্য কমেছে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ হারে। যেখানে শহরে দারিদ্র্য কমেছে মাত্র শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ হারে।
এমন বৈরী বাস্তবতার মধ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য দূরীকরণ দিবস। ১৯৯৩ সাল থেকে জাতিসংঘ ঘোষিত দিবসটি পালন করা হচ্ছে। ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান অর্জনের অক্ষমতাকে দারিদ্র্য হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে থাকে বিশ্বব্যাংক। সে হিসাবে দিনে ২ দশমিক ১৫ ডলারের কম আয়ের মানুষকে অতিদরিদ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপ বলছে, দেশে দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে অতিদারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
এদিকে গত মঙ্গলবার প্রকাশিত বাংলাদেশের হালনাগাদ উন্নয়ন পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০২২ সালে দেশের প্রতি ১০ জনের মধ্যে অন্তত চারজন হয় গরিব অথবা দরিদ্র্য হওয়ার ঝুঁকিতে ছিল। অন্যদিকে আয় বৈষম্যও নগর দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। সাম্প্রতিক বছরে দারিদ্র্য কমলেও আয় বৈষম্য বেড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার পতনের দাবিতে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে জনজোয়ারের পেছনে আর্থসামাজিক বিভিন্ন কারণের মধ্যে দারিদ্র্যও একটা বড় কারণ হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।
শহরমুখী মানুষের ঢল সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, নদীভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এ কারণে দারিদ্র্যের ঝুঁকি এখন গ্রাম থেকে নগরমুখী। দেশে প্রতি চারজনে একজন শহরে বসবাস করেন।
দারিদ্র্য ঝুঁকির অনুমান ছাড়াও বিশ্বব্যাংক বলেছে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে অতি দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে ৬ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ। তবে ওই অর্থবছরের প্রকৃত হিসাব এবং প্রতিবেদন এখনও প্রকাশ করা হয়নি। শিল্প উৎপাদনে মন্থরগতি ও প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি মূল্যস্ফীতির কারণে এ পরিস্থিতি।
দারিদ্র্য ও দারিদ্র্য ঝুঁকির কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত দুই অর্থবছর দেশের শিল্প এবং সেবা খাতে নানা নেতিবাচক প্রভাব ছিল। শুধু গত অর্থবছরে এ কারণে চাকরি হারিয়েছে ৪ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ। বছরটিতে মজুরি প্রায় ১ শতাংশ কমেছে। এতে চাকরি হারানো পরিবারগুলো দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। একই কারণে অতিদারিদ্র্য শূন্য দশমিক ৭ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়েছে বলে ধারণা করা হয়; অর্থাৎ দেশে অতিদারিদ্র্য মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ লাখ।
- বিষয় :
- দারিদ্রতা