বিশ্ব স্ট্রোক দিবস আজ
স্ট্রোকের চিকিৎসা শুধু ঢাকায়

প্রতীকী ছবি
তবিবুর রহমান
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৪ | ২৩:০৪
ঝিনাইদহ জেলার বাসিন্দা রিজিয়া বেগম (৫৪)। গত ১৫ আগস্ট বেলা ১১টায় বাসায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন। প্রথমে তাঁকে জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসকরা তাঁকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু শয্যা খালি না থাকায় সেখানে ওই দিন ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। পরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। সেখানকার এক চিকিৎসকের সুপারিশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ভর্তি করা হয়।
এসব কারণে চিকিৎসা শুরু হতে তিন দিন পার হয়ে যায়। রিজিয়া বেগমের ছেলে আনোয়ার হোসেন বলেন, চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, স্ট্রোক হয়েছিল। এতে মস্তিষ্কের রক্তনালিতে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া যায়নি। এখন দীর্ঘদিন ভর্তি রেখে চিকিৎসা দিতে হবে।
একই রকম অবস্থা সিরাজগঞ্জ থেকে চিকিৎসা নিতে রাজধানীতে আসা ব্যবসায়ী মো. আমিনুল ইসলামের। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ৭ অক্টোবর সকাল ১০টায় হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি। মুখ এক দিকে বেঁকে যায়। স্বজনরা প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে নেওয়া হয়। তবে ধীরে ধীরে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। গত রোববার ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জানা যায় আমিনুলের স্ট্রোক হয়েছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, স্ট্রোকের রোগীর জন্য প্রথম চার ঘণ্টা গোল্ডেন আওয়ার বা অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়। এই সময়ের মধ্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারলে ৮০ ভাগ রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে এর চিকিৎসা ব্যবস্থা শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক। রাজধানীর ঢামেক হাসপাতাল, বিএসএমএমইউ ও নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল এবং পাঁচটি বেসরকারি হাসপাতালে স্ট্রোক ব্যবস্থাপনার সুবিধা রয়েছে। এ ছাড়া আট বিভাগে আটটি স্ট্রোক সেন্টার চালু করার কথা থাকলেও এখনও কার্যকর হয়নি। দেশে স্ট্রোকের চিকিৎসা অপ্রতুল হওয়ায় মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের ঝুঁকি বাড়ছে।
এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ মঙ্গলবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্ট্রোক দিবস। স্ট্রোক সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে
প্রতি বছর ২৯ অক্টোবর দিবসটি পালিত হয়।
এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য– ‘একত্রে আমরা স্ট্রোকের চেয়ে বড়’।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসায়েন্স বিভাগের গবেষণায় জানা গেছে, প্রতি ছয়জনের একজন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। দেশে স্ট্রোকে আক্রান্তের সংখ্যা ১৮ লাখ। বিপুল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসায় ২১২ জন নিউরোসার্জন রয়েছেন। কিন্তু প্রয়োজন ১ হাজার ৬০০ জন নিউরোসার্জন। চিকিৎসকরা বলছেন, বিশ্বে বছরে দেড় কোটি মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে মারা যায় ৫০ লাখ। একই সংখ্যক মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেন। সচেতনতার ঘাটতি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য সেবনের প্রবণতা, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনসহ নানা কারণে স্ট্রোকে মৃত্যু বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বিএসএমএমইউর নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ বলেন, স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তির ১৯ লাখ করে মস্তিষ্কের কোষ (নিউরন) প্রতি মিনিটে মরে যেতে থাকে। যত মস্তিষ্কের কোষ মারা যায়, তত মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে থাকে। যত সময় যায়, তত ক্ষতি বাড়ে। স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর চার ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারলে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। এই ক্ষতি হওয়া বন্ধে দ্রুত চিকিৎসা দরকার। সে কারণে স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসার উদ্যোগ নিতে হবে, রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। এ জন্য কমিউনিটি পর্যায়ে স্ট্রোকের প্রাথমিক ধারণা দেওয়া জরুরি।
নিউরোসায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক নিয়ে বিভ্রান্তি বা ভুল বোঝাবুঝি আছে। হার্ট অ্যাটাকে বুকে ব্যথা করে, চাপ অনুভূত হয়, শরীর ঘামতে থাকে।
স্ট্রোকে কথা জড়িয়ে যায়, মুখ বেঁকে যায়। স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তি হাত-পা নাড়াতে পারেন না।
এসব লক্ষণ দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, রোগীকে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ নাকি স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিতে হবে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইব্রাহিম খলিল বলেন, বিশ্বে পঙ্গুত্বের অন্যতম কারণ স্ট্রোক। এ থেকে বাঁচতে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা জরুরি। সবজি, ফলমূল, নিরামিষ এবং মাছ খেতে হবে। লবণ ও লাল মাংস পরিহার করতে হবে। প্রতিদিন একটু হাঁটাহাঁটি করতে হবে। সিগারেট, অ্যালকোহল বাদ দিতে হবে। ওজন বেশি থাকলে কমাতে হবে। যাদের স্ট্রোক করে তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। তাই সরকারের পক্ষ থেকে পুনর্বাসনের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
- বিষয় :
- অসুখ