ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

খাদ্যপণ্যে পুষ্টিগুণ

মোটা লবণে আয়োডিনের ঘাটতি

ন্যূনতম ২০ পিপিএমের বিধান থাকলেও গড়ে থাকে ৫

মোটা লবণে আয়োডিনের ঘাটতি

ফাইল ছবি

 ইয়াসির আরাফাত

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:৩৮

বাজারে সহজলভ্য মোটা লবণে আয়োডিনের ব্যাপক ঘাটতির তথ্য পাওয়া গেছে। দাম কম হওয়ায় নগরীর রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে স্বল্প আয়ের মানুষ এ লবণ বেশি ব্যবহার করেন। এতে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যঝুঁকির শঙ্কা বাড়ছে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের লবণ খেয়ে মানবদেহে যে আয়োডিনের ঘাটতি তৈরি হয়, তাতে গলগণ্ডসহ নানা রোগ হতে পারে। এ ছাড়া শিশু-কিশোরের স্বাভাবিক মেধা বিকাশ ব্যাহত হতে পারে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) ইনস্টিটিউট অব ফুড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এবং বেসরকারি ওয়াফেন রিসার্চ ল্যাবের পরীক্ষায় মোটা লবণে আয়োডিন ঘাটতির এ চিত্র উঠে এসেছে। জনস্বার্থে এক ভোক্তা মোটা ও চিকন লবণের নমুনা প্রতিষ্ঠান দুটিতে পাঠান। পরীক্ষার পৃথক রিপোর্টে দেখা যায়, ছয়টি বড় কোম্পানির লবণে আয়োডিনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকলেও বিভিন্ন কোম্পানির মোটা লবণে এর ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এক কেজি লবণে ৫০ পয়সা মূল্যের আয়োডিন প্রয়োজন। অথচ এ খরচটুকু করতে আগ্রহী নন মোটা লবণের প্রস্তুতকারকরা। তবু প্যাকেটের গায়ে প্রতারণামূলক লেখা থাকে ‘আয়োডিনযুক্ত’। 

মোটা লবণকে খোলা লবণ বলা হলেও এগুলো বিক্রি হয় পলিথিনের প্যাকেটেই। এর দাম চিকন লবণের চেয়ে কম। দানা খসখসে ও অপেক্ষাকৃত মোটা। দোকানিরা জানান, এ লবণ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুতকারক কারখানায়ও ব্যবহার হয়। তবে হোটেল-রেস্তোরাঁ ও নিম্ন আয়ের মানুষের রান্নায় এ লবণ বেশি ব্যবহার হতে দেখা যায়। রাজধানীর ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও ও মগবাজারের ১১টি রেস্তোরাঁ ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশতেই মোটা লবণ ব্যবহার করা হচ্ছে।

কারওয়ান বাজার ঘুরে চট্টগ্রামের এ কে সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের ডি-আর লবণ, পটিয়া সুপার, দেশি, বনফুল, হোসাইন সুপার নামে মোটা লবণ বিক্রি হতে দেখা গেছে। সব লবণের প্যাকেটেই ‘আয়োডিনযুক্ত’ কথাটি বড় করে লেখা থাকলেও বাস্তবে দেখা যায় উল্টো চিত্র। এ ধরনের লবণে আয়োডিনের উপস্থিতি নির্ধারিত মানের চেয়ে অনেকটাই কম। লবণে ন্যূনতম ২০ পিপিএম আয়োডিনের উপস্থিতি থাকার বিধান থাকলেও, রয়েছে গড়ে ৫ পিপিএম। 

বিসিএসআইআরের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, চট্টগ্রামের এ কে সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের ডি-আর লবণে আয়োডিন পাওয়া গেছে মাত্র ৫ দশমিক ৩৭ পিপিএম। এ ছাড়া হোসাইন সুপার সল্টে ৩ দশমিক ৪০, পটিয়া সুপার সল্টে ৮ দশমিক ৬৯ এবং পিওর এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের ‘দেশি আয়োডিনযুক্ত লবণ’-এ ৪ দশমিক ৬৬ পিপিএম আয়োডিন মিলেছে। মোটা লবণের সব কোম্পানির প্যাকেটের গায়ে ‘বিসিক ও ইউনিসেফের সহযোগিতায় আয়োডিনযুক্ত’ কথা লেখা আছে। বাস্তবে পর্যাপ্ত আয়োডিন নেই।

বাজারের সম্ভবত একমাত্র পণ্য এ মোটা লবণ, যা এখনও সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হয়। বড় বড় কোম্পানির ভ্যাকুয়াম পদ্ধতিতে তৈরি মিহিদানার লবণ যেখানে ৪২ টাকা কেজি বিক্রি হয়, মোটা লবণের কেজি সেখানে ৩০ টাকারও কম। ফলে অর্থ সাশ্রয়ে নিম্ন আয়ের মানুষ এ লবণ কেনেন।
মোটা লবণের এ দশা হলেও চিকন লবণে পর্যাপ্ত মাত্রায় আয়োডিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সম্প্রতি বিসিএসআইআরের পরীক্ষায় দেখা গেছে, মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ লবণে ৪০ দশমিক ৮৭ পিপিএম, মোল্লা সুপারে ৩৮ দশমিক ৭১, কনফিডেন্সে ৩৬ দশমিক ৫৬, এসিআইয়ে ৩৫ দশমিক ৪৯, মুসকানে ২৭ দশমিক ৯৬, তীরে ৩২ দশমিক ২৬ পিপিএম আয়োডিনের উপস্থিতি রয়েছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) লবণ উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীদের আয়োডিন সরবরাহ করে। বিসিকের লবণ সেলের প্রধান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সরোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, বাজারজাত পর্যায়ে ২০ পিপিএমের কম থাকলে সেটি আইনের লঙ্ঘন। যেসব লবণে এর কম পাওয়া যাবে, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরোয়ার হোসেন বলেন, যারা লবণ উৎপাদনকারী আছেন, সবাই তাদের কাছ থেকে আয়োডিন নিতে বাধ্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক খালেদা ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘আয়োডিন ঘাটতির স্বাস্থ্যঝুঁকি বিশাল। যারা ইচ্ছা করে আয়োডিন দেন না, তারা অনেক বড় অন্যায় করেন। এটা বাধ্যতামূলক। তিনি বলেন, থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে আয়োডিন খুবই দরকারি। শরীরের প্রায় সব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে এ হরমোন। এর অভাবে গলগণ্ড হয়। আবার দেখা যায়, অনেকের চোখ বের হয়ে আসছে, হাত কাঁপে, অল্প খেলেও ওজন বেড়ে যায়, বিষণ্নতা কাজ করে।’ তিনি বলেন, ‘ছোটদের ক্ষেত্রে আয়োডিনের 
অভাবে জিহ্বা ফুলে যায়; নানাবিধ শারীরিক বৈকল্য দেখা দেয়। আয়োডিনের অভাবে শিশুদের মেধা বিকাশ ব্যাহত হয়। মায়েদের ক্ষেত্রে অনেক সময় বাচ্চা গর্ভে মারা যায় বা অসুস্থ অবস্থায় জন্মায়।’ 

আরও পড়ুন

×