ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

উপকূলীয় শিশু: শেষ

সুপেয় পানির সংকটে হুমকিতে শিশুস্বাস্থ্য

সুপেয় পানির সংকটে হুমকিতে শিশুস্বাস্থ্য

শ্যামনগরের কলবাড়ি গ্রামে পানি সংগ্রহের জন্য অপেক্ষা করছে নারী ও শিশুরা- সমকাল

 আবু সালেহ রনি, উপকূল থেকে ফিরে

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:২৪ | আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৪ | ১০:০১

সুন্দরবন লাগোয়া সাতক্ষীরার শ্যামনগরের দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। সমুদ্র উপকূলের দ্বীপটি কপোতাক্ষ নদ আর খোলপেটুয়া নদীতে ঘেরা। চারদিক পানিতে থইথই করলেও এখানকার মূল সংকট সুপেয় পানি। গ্রীষ্মে এই সংকট আরও প্রকট হয়। এপ্রিলের শেষ ভাগ থেকে পরের তিন মাস ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ নলকূপে ওঠে না পানি। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূলের শিশুরা। অধিকাংশ শিশুই পান করছে প্রয়োজনের চেয়ে কম পানি। লবণাক্ত পানির প্রভাবে বছরের কোনো কোনো সময় প্রাকৃতিক ঘাস সংকটের কারণে গবাদি পশু পালনেও ধুঁকতে দেখা যায় এ অঞ্চলের মানুষকে। 

শ্যামনগরের নীলডুমুর নৌঘাট থেকে খোলপেটুয়া নদী পার হলেই গাবুরা ইউনিয়ন। সরেজমিন দেখা যায়, শুধু ভূপৃষ্ঠে থাকা পানি নয়, ভূগর্ভস্থ পানিও ধীরে ধীরে লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। নলকূপেও উঠে আসে লবণাক্ত পানি। স্থানীয়দের খাওয়ার পানি আনতে ডিঙাতে হয় প্রায় তিন কিলোমিটার পথ। প্রতি বাড়িতেই আছে বিভিন্ন আকারের বড় বড় পানির ড্রাম। যাতে পুরো বছর বৃষ্টির পানি ধরে রাখা হয়। টিনের চাল ঘিরে বিশেষ ব্যবস্থায় পানি সরাসরি সংরক্ষণ করা হয় এসব ড্রামে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ক্ষতির পরও কিছু দিন পরপর বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে সুন্দরবনের পাশের সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালিগঞ্জ এবং খুলনার কয়রা ও দাকোপের প্রায় সর্বত্র। সরকারিভাবে সুন্দরবন এলাকায় বন বিভাগের যেসব ফাঁড়ি বা ক্যাম্প রয়েছে, সেখানেও সুপেয় পানি সংরক্ষণের নানা কৌশল দেখা গেছে।

সুপেয় পানির এই সংকট শুধু গাবুরাবাসীর নয়, উপকূলের ১৯ জেলায় প্রায় ৩ কোটি ৯০ লাখ মানুষকে একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তবে সুন্দরবনের পাশের পাঁচ উপজেলার জনসংখ্যা ১৩ লাখ ৭ হাজার ৯৫০। প্রতিদিন এই জনগোষ্ঠীর সুপেয় পানির চাহিদা ৩৮ লাখ ৪২ হাজার ১৩৬ লিটার। এর মধ্যে শুধু কয়রায় ৩৫, শ্যামনগরে ২৫ এবং কালিগঞ্জে ১৫ শতাংশ পানি নলকূপের মাধ্যমে মেলে। এর বাইরে পানির পুরো চাহিদা বৃষ্টি, পুকুর, নদীসহ বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। পর্যাপ্ত পানির উৎস না থাকায় বিপদে আছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। আর আর্সেনিকযুক্ত পানির জন্যও বাসিন্দাদের আক্রান্ত হতে হয় নানা রোগে। লবণাক্ত পানির কারণে শিশুর বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। মা-বাবার সঙ্গে শিশুদেরও মাইলের পর মাইল হেঁটে বিভিন্ন এলাকা থেকে সুপেয় পানি আনতে হয়। কেউ কেউ নৌকা বেয়ে পানি আনে। আবার স্কুল বাদ দিয়েও অনেক শিশুকে ছুটতে হয় পানির সন্ধানে। 

গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম সমকালকে বলেন, ‘৪৮ হাজার জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই ইউনিয়নে ১৫ গ্রাম। চার গ্রামে আংশিক সুপেয় পানির ব্যবস্থা আছে। ১১ গ্রামের অবস্থা খুবই খারাপ। গরু দুধ দিলে শিশুরা খেতে পারে। কিন্তু পানির অভাবে কৃষিসহ গবাদি পশু পালনও কষ্টসাধ্য। প্রকৃতির বিরুদ্ধে স্থানীয়দের এ লড়াই চলছে।’ 

লবণাক্ত পানির ব্যবহার ও সুপেয় পানি কম খাওয়ার বিষয়ে শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আসম আলমগীর চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘শিশুসহ যে কারও জন্য শারীরিক ক্ষতি বহুমাত্রিক। পানি কম খেলে দেহে পানিশূন্যতা, দ্রুত ক্লান্তি, কিডনি ও হজমে সমস্যা, ত্বক ও মূত্রনালি সংক্রমণ, ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতার পাশাপাশি অ্যান্টিবডির উৎপাদন কমে যাওয়া অর্থাৎ, ইমিউন ফাংশনে সমস্যা দেখা দিতে পারে। ক্ষতিগুলো দীর্ঘ মেয়াদে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যমান হবে। এজন্য উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হবে।’ 

উপকূল পরিস্থিতি

উপকূলের পাঁচ উপজেলায় রয়েছে সহস্রাধিক সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী প্রায় ২ লাখ। বিদ্যালয়গুলোর নলকূপে আর্সেনিকের মাত্রা বিপৎসীমার ওপরে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলের পানিতে লবণের সহনীয় মাত্রা প্রতি লিটারে ১৫০ থেকে ৬০০ মিলিগ্রাম। আর উপকূলে এ মাত্রা প্রতি লিটারে ১ হাজার মিলিগ্রাম। অধিকাংশ বিদ্যালয়ে স্থাপিত নলকূপের পানিতে ক্লোরাইড, আর্সেনিক ও আয়রনের মাত্রা অনেক বেশি। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নলকূপের পানিতে আর্সেনিক থাকায় অধিকাংশ বিদ্যালয় পুকুরের পাশাপাশি ড্রামে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে। সেই পানি শেষ হয়ে গেলে পুকুরের পানি ফিটকিরি দিয়ে বিশুদ্ধ করার পর পানের উপযোগী করা হয়। অনেক বিদ্যালয়ের ছাদে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ট্যাঙ্ক লাগানো হয়েছে। তা থেকেও শিশুরা উপকৃত হচ্ছে। কয়রার বানিয়াখালীসহ অনেক স্কুলে খাবার পানির কোনো ব্যবস্থাই রাখা হয়নি।

কয়রা বানিয়াখালী সুন্দরবন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মীন্ময় বিশ্বাস বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানে ৬৬ শিক্ষার্থী। স্কুলে খাওয়ার পানির ব্যবস্থা নেই। নলকূপ থাকলেও এর পানি লবণ ও আয়রণযুক্ত। শিক্ষকসহ শিশুরা বাড়ি থেকে পানি নিয়ে আসেন। পানি কেনার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। কারণ, পানি কিনতে হলে ২ কিলোমিটার দূরে যেতে হয়। 

গাবুরা চাঁদনীমুখা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহসিন হোসেন বলেন, পানি সংকটই প্রধান সমস্যা। প্রতিষ্ঠানে রয়েছে ২৭৬ শিক্ষার্থী। তাদের জন্য ৫ হাজার লিটারের চারটি ড্রামে ২০ হাজার লিটার বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হয়। সারা বছরই এই পানি দিয়ে চলতে হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। 
জানা গেছে, পাঁচ উপজেলার ৫১ ইউনিয়নে গভীর নলকূপ বসালেও অধিকাংশেরই পানি পানযোগ্য নয়। এসব নলকূপের পানি গৃহস্থালিসহ অন্য কাজে ব্যবহৃত হয়। একই চিত্র উপকূলের অন্য উপজেলায়ও।

গবাদি পশু ও শস্যের ক্ষতি

কপোতাক্ষ, শিবসা, হাড়িয়া, হড্ডা, খোলপেটুয়া, মাদার, চুনকড়ি, মালঞ্চ, কালিন্দি, ইছামতীসহ অন্তত দেড় ডজন নদী উপকূলের পাঁচ উপজেলাকে ঘিরে রেখেছে। শিশুরা এসব নদীতে মাছ ধরলেও বিশুদ্ধ করার পরও এর পানি পানের উপযোগী নয়। কারণ, এই অঞ্চলে নোনাপানিতে চিংড়ি চাষ করার ফলে নদীর লবণাক্ততা পানি পোল্ডার অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। এর প্রভাব রয়েছে শস্য উৎপাদনেও। 

মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, জমিতে ৪ ডিএস/মিটার লবণাক্ততা ফসল উৎপাদনের জন্য স্বাভাবিক ধরা হয়। তাদের সমীক্ষায় দেখা গেছে, উপকূলীয় এলাকার জমিতে লবণাক্ততার পরিমাণ গড়ে প্রতি মাসে ১১ ডিএস/মিটার। কোথাও কোথাও লবণাক্ততা ১৭ ডিএস/মিটার পাওয়া যায়। অন্যদিকে, এসব এলাকায় নদীতে লবণাক্ততার গড় ১৬ ডিএস/মিটারেরও বেশি। ফলে এসব এলাকায় শস্যের উৎপাদন অনেকটাই কমে গেছে। লবণাক্ততার কারণে গবাদি পশু– গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি পালনেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। 

শ্যামনগরের নূরনগর ইউনিয়নের কৃষক মো. ওয়েজকরুনি সমকালকে বলেন, নোনাপানির কারণে অনেক ফসল ও শাকসবজি চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। গবাদি পশু পালনেও সমস্যা হয়। ছাগল, হাঁস, মুরগি থাকলেও তাদের পর্যাপ্ত পানি দেওয়া যায় না। তিনি জানান, নূরনগর বাজার থেকে প্রতিদিন তাঁর ৩০ লিটার পানির জন্য ১৫ টাকা এবং যাওয়া-আসা বাবদ ভ্যান ভাড়া ২০ টাকা খরচ হয়।

পানির পেছনেও খরচ অনেক

আশাশুনির পাইথালী কুন্দুড়িয়ায় দেড় যুগ আগে বেসরকারি উদ্যোগে পুকুর থেকে পানি ফিল্টারিংয়ের প্লান্ট তৈরি করা হয়। এখন সেখান থেকে ১০ থেকে ১৫ গ্রামের মানুষ পানি নিতে আসে প্রতিদিন। এখান থেকে পানি নিতে হলে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৫০ টাকা দিতে হয়। ওই টাকা দিয়েই পরিশোধ করা হয় ওই প্লান্টের বিদ্যুৎ বিলসহ অন্য খরচ। একই চিত্র দেখা গেছে, শ্যামনগরের ভবানীপুরে। সেখানেও দিঘির পানি বর্ষা মৌসুমে সংরক্ষণ করা হয়। পরে সেই পানি ফিল্টারিংয়ের মাধ্যমে ব্যবহারের উপযোগী করা হয়। উপকূলীয় অন্য উপজেলার গ্রামগুলোতেও পানি সংরক্ষণের খরচ একই রকম। বন্ধু, ডরপসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অনেক গ্রামে সুপেয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিতে সহায়তা দিচ্ছে। তবে সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ, যাতায়াতসহ অতিরিক্ত খরচ দিতে হচ্ছে দারিদ্র্যপীড়িত উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের। এতেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। কারণ, তাদের পরিবারের ওপর আর্থিক চাপ বাড়ছে। 

বৃষ্টির অপেক্ষা 

উপকূলবাসী বর্ষার শুরু থেকে আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত সরাসরি বৃষ্টির পানি পান করেন। শুষ্ক মৌসুমে সংকট ঘনীভূত হয়। সরেজমিন খুলনার কয়রার বানিয়াখালী সুন্দরবন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেলে শিক্ষার্থী বর্ষণ, তুয়া, সাদিয়া, দোলন, রূদ্র, রাকেশ থেকে শুরু করে সবারই একই কথা– বৃষ্টি হলেই তারা খুশি। তবে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে তাদের। শিক্ষক মিঠুন মণ্ডল বলেন, ‘বৃষ্টি আমাদের জন্য আশীর্বাদ।’ একই স্কুলের শিক্ষার্থী বর্ষণ জানায়, অনেক সময় তারা বাড়ি থেকে পানি আনতে ভুলে যায়। তখন বন্ধুদের থেকে পানি চেয়ে পান করে। 

যা বলছে কৃর্তপক্ষ 

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী তুষার মোহন সাধু খাঁ বলেন, উপকূলে খাবার পানির সংকট দীর্ঘদিনের। সরকার পরিস্থিতি উন্নয়নে দুটি বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে এই বছর বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলের ১৩ জেলার জন্য আরও একটি বিশেষ প্রকল্প নেওয়ার প্রস্তুতি শেষ করেছে। বিশ্বব্যাংকই এতে অর্থায়ন করবে। আশা করছি, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে উপকূলে পানির সংকট অনেকাংশে কমে যাবে।

পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার কারণে সুপেয় পানির তীব্র সংকট রয়েছে। ফসল উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাদের পানি কিনে খেতে হয়। যেটা উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যকে ত্বরান্বিত করছে। আর কিনে খেতে হয় বলে স্থানীয়রা পানিও কম খায়। 

উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য সরকার ইতোমধ্যে ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান (ন্যাপ) প্রণয়ন করেছে জানিয়ে বিশিষ্ট এই জলবায়ু বিশেষজ্ঞ বলেন, আমরা এটি প্রণয়ন করে দিয়েছি। এখন সরকারকেই এটি বাস্তবায়ন করতে হবে, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও তদারকি করতে হবে। নয়তো উপকূলে সংকট থেকেই যাবে।

আরও পড়ুন

×