আমলানির্ভর পেট্রোবাংলা বাড়ছে জ্বালানি সংকট

.
হাসনাইন ইমতিয়াজ
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:২৬ | আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ১২:৩৮
দিন দিন জ্বালানির চাহিদা বাড়ছে। বিদ্যুৎ এবং শিল্প খাতে গ্যাস সংকট আরও প্রকট। কিন্তু আমলানির্ভর পেট্রোবাংলা চলছে শম্বুক গতিতে। লোক দেখানো পরিকল্পনা আর দফায় দফায় বৈঠক করেই সময় পার করছে সংস্থাটি। ২০১৫ সালে যেখানে দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের জোগান ছিল দিনে ২৭০ কোটি ঘনফুট; গত ৯ বছরে তা কমে হয়েছে ২২২ কোটি ঘনফুট। দেশের গ্যাস অনুসন্ধানে ধীরগতি ও এলএনজি আমদানিতে ঝোঁক জ্বালানি খাতে বড় সংকট তৈরি করেছে। চাহিদা অনুসারে গ্যাস না পাওয়ায় শিল্প, বাণিজ্য ও বিদ্যুৎ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পিছিয়ে পড়ছে অর্থনীতি।
অনুসন্ধানে স্থবিরতার পাশাপাশি গ্যাস সরবরাহ এবং রাজস্ব আদায়েও ব্যর্থ পেট্রোবাংলা। সিস্টেম লসের নামে শিল্পকারখানায় অব্যাহত গ্যাস চুরির ঘটনা ঘটছে। কিছু অভিযান চালানো হলেও গ্যাসের অপব্যবহার বন্ধ হচ্ছে না। দেশে গ্যাসের চাহিদা দিনে ৪২০ কোটি ঘনফুট।
সূত্র জানায়, গত কয়েক বছরে নানা ধরনের পরিকল্পনা নিয়েছে পেট্রোবাংলা। তার মধ্যে ১০০ কূপ খননের উদ্যোগ ও সমুদ্রে গ্যাস ব্লক ইজারা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে এসব পরিকল্পনার খুব কমই বাস্তবায়ন হয়েছে। ভোলা ও সিলেটে কয়েকটি নতুন ও পুরোনো কূপে মিলেছে গ্যাস, যা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। ২০১৪ সালের পর থেকে সমুদ্রে গ্যাসের অনুসন্ধানে সিরিজ বৈঠক, টেন্ডার ও পরিকল্পনাতেই আটকে আছে। ফলে দেশের জ্বালানি খাত দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানিসহ গ্যাসের গড় ক্রয়মূল্য ছিল প্রতি ঘনমিটার ২৪ দশমিক ৩৮ টাকা এবং বিক্রয়মূল্য ২২ দশমিক ৮৭ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ঘনমিটারে ১ দশমিক ৫৬ টাকা লোকসান হয়েছে পেট্রোবাংলার। গত অর্থবছরে খোলাবাজার থেকে আনা এলএনজির দাম পড়েছিল ৬৫ টাকা, যা গত আগস্টে ৭১ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। গ্যাস আমদানি ও বিক্রির মধ্যে ব্যবধান বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ সিস্টেম লসের নামে চুরি। বছরের পর বছর চেষ্টা করেও পেট্রোবাংলা তা ঠেকাতে পারেনি।
পেট্রোবাংলার পরিচালনা পর্ষদের ৯ সদস্যের ছয়জনই আমলা। এর মধ্যে চেয়ারম্যান হন একজন অতিরিক্ত সচিব। আর পরিচালক প্রশাসন ও অর্থ পদে দু’জন যুগ্ম সচিব নিয়োগ পান। এ ছাড়া পর্ষদে অর্থ, জ্বালানি ও পরিকল্পনা বিভাগ থেকে একজন করে যুগ্ম সচিব থাকেন। পেট্রোবাংলার নিজস্ব জনবল থেকে পরিচালক হন মাত্র তিনজন।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে পেট্রোবাংলা চলছে আমলা দিয়ে। তারা জনস্বার্থ না দেখে গত আওয়ামী সরকারের দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের হয়ে কাজ করেছেন। সরকারের পতনের পরও এই খাতে তেমন পরিবর্তন আসেনি; একই ধারায় চলছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এভাবে চলতে থাকলে পেট্রোবাংলা যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে তাতে আগামী ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে তেমন কোনো সফলতা আসবে না। দেশের চাহিদা মেটাতে আমদানিনির্ভর এলএনজিই হবে একমাত্র ভরসা। তবে দেশের আর্থিক খাতে যে সংকট তাতে এলএনজি আমদানি করে চাহিদা আদৌ মেটাতে সরকার সক্ষম হবে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, পেট্রোবাংলাকে গতিশীল করতে হলে আমলানির্ভরতা কমাতে হবে। কারণ খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে প্রয়োজন দক্ষ ভূতত্ত্ববিদ ও প্রকৌশলী। কিন্তু এখানে অতিরিক্ত সচিবকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা সচিব হওয়ার আশায় থাকেন। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বা সংস্থার উন্নয়নে তাদের ভাবনা কম থাকে। তারা সবসময় সরকারের তুষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকেন।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম সমকালকে বলেন, ভুল নীতি আর দুর্নীতির ওপর ভর করেই চলছে দেশের জ্বালানি খাত। আমলা দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালিয়ে কখনোই জনগণের স্বার্থ রক্ষা হবে না।
তিনি বলেন, ২০২৫-২৬ সালের দিকে যে বাংলাদেশের গ্যাস খাতে সংকট প্রকট হতে পারে– সেটা অনেক আগেই বলা হয়েছে। তবু পেট্রোবাংলা কার্যত তেমন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার সম্প্রতি এক সেমিনারে বলেছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ কূপ খননের মাধ্যমে ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে পেট্রোবাংলার। ইতোমধ্যে ১৬ কূপ খননের মাধ্যমে ১৯ কোটি ঘনফুট উৎপাদন বেড়েছে। এ ছাড়া ২০২৮ সালের মধ্যে আরও ১০০ কূপ খননে প্রকল্প, পার্বত্য এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধান এবং সাগরে গ্যাস উত্তোলনের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম বলেন, সর্বোচ্চ চেষ্টা করলে বছরে ১০ কূপ খনন করা সম্ভব। সেখানে বছরে ৩০-৩৫টি কূপ খননের পরিকল্পনা পুরো অবাস্তব।
- বিষয় :
- পেট্রোবাংলা
- গ্যাস
- অন্তর্বর্তী সরকার