ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

জলবায়ু সম্মেলন

বাকুতে ভূরাজনীতির ছায়া, সুখবর নেই বাংলাদেশের

বাকুতে ভূরাজনীতির  ছায়া, সুখবর নেই  বাংলাদেশের

ফাইল ছবি

 জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৪ | ০১:২২

নামে সাগর যুক্ত থাকলেও পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হ্রদ ‘কাস্পিয়ান সাগর’। আকারে বাংলাদেশের প্রায় দেড় গুণ। কাস্পিয়ান তার চারপাশের শুষ্ক অঞ্চলের জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। অথচ জলবায়ু সংকটে নিজেই পড়েছে সংকটে। ফলে কাস্পিয়ান সাগরের তীরে আজারবাইজানের বাকুতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ২৯ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল। তবে সপ্তাহ দুয়েকের আয়োজনে তীব্র দরকষাকষির পর মোড়ল রাষ্ট্রগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যে ৩০০ বিলিয়ন ডলার দিতে সম্মত হয়েছে, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো।

বাংলাদেশ সময় গতকাল রোববার ভোর ৫টায় চুক্তিতে কিছু পরিবর্তনের পর অংশ নেওয়া বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধিরা ঐকমত্যে পৌঁছান। চুক্তি ২০৩৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে– এটিই সম্মেলনের বড় অর্জন বলা হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ অর্থ সহায়তা দেবে আশা করা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো তহবিল থেকে ন্যায্য পাওনা কতটা পাবে, তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা। তারা সম্মেলনকে উন্নত এবং ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যকার ‘ত্রুটিপূর্ণ আপস’ হিসেবে দেখছেন।

অর্থের উৎস কী, কোন দেশ কীভাবে নতুন তহবিল পাবে– তার কোনো কাঠামো তৈরি হয়নি। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ক্ষতিপূরণ পাওয়া প্রতিশ্রুতিতেই আটকে থাকার শঙ্কা জোরালো।
সম্মেলনে ভুক্তভোগী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি সমকালকে বলেছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দের প্রস্তাব আশ্চর্যজনকভাবে অপ্রতুল। এ অর্থ প্রতিশ্রুতি কোনো সমাধান নয়। অর্থের জোগান কোন উৎস থেকে, সেটিই মুখ্য। প্রতিশ্রুত অর্থ কোন দেশ কবে পাবে, তা চরম অনিশ্চিত। ঘোষণার মাধ্যমে উন্নত বিশ্ব দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশের আশ্বস্ত হওয়ার কিছু নেই।

সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (সিপিআরডি) প্রধান নির্বাহী ও জলবায়ু ন্যায্যতা জোট বাংলাদেশের সমন্বয়কারী মো. শামছুদ্দোহা বলেন, কপ২৯ ব্যর্থতার জন্য চলমান উন্নয়ন দর্শন তথা নয়া উদারতাবাদ, অর্থনৈতিক কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উন্নত দেশের বাড়াবাড়ি দায়ী। কারণ, কার্বন নির্গমন হ্রাসে উন্নত দেশ বাধ্যতামূলক লক্ষ্যমাত্রা মেনে নেয়নি। অর্থায়নের প্রায় পুরোটা আন্তর্জাতিক অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর ছেড়ে দিয়ে তারা লগ্নির সুযোগ বাড়িয়েছে।

জ্বালানি তেলের আঁতুড়ঘরে আয়োজন, মার্কিন মুলুকের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়, ভূরাজনীতি, বহুজাতিক কোম্পানি প্রতিনিধিদের বিশাল বহর, পৃথিবীর শীর্ষ ধনী দেশের নির্লিপ্ততায় শুরু থেকেই কপ২৯ অর্থহীন হয়ে পড়ে, যার রেশ শেষ দিন গত শুক্রবারও ছিল। দরকষাকষি, তীব্র অসন্তোষ, বাদানুবাদ, প্রত্যাখ্যান-বয়কটসহ নানা নাটকীয়তায় অবশেষে গতকাল শেষ হয় জলবায়ুর সবচেয়ে বড় এ আসর। এর জন্য সময় লেগেছে অতিরিক্ত ৩৩ ঘণ্টা। ‘বানোয়াট কুতর্ক’ আর ‘মিথ্যা সমাধানের’ বিজ্ঞাপন দিয়ে পৃথিবীর বাঁচা-মরার প্রশ্নের সম্মেলনের গতিকে অযথা বিনষ্ট করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে অর্থসহায়তা দিতে বাধ্য ধনী দেশগুলো। কারণ ধনীর দেশগুলোর মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণই ঝুঁকি বাড়িয়েছে। বাকুতে ১১ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া সম্মেলন থেকে দরিদ্র দেশগুলো আশা করেছিল, তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্থসহায়তা দেবে ধনীরা। তবে সম্মেলনে দাপট দেখান মধ্যস্থতাকারীরা। তারা মূলত বিশ্বের বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কাজ করেন।

বর্তমানে ধনী দেশগুলো প্রতিবছর জলবায়ু তহবিলে ১০০ বিলিয়ন ডলার দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। গত শুক্রবার খসড়া চুক্তিতে তা বাড়িয়ে ২৫০ বিলিয়ন ডলার করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে আপত্তি জানায় উন্নয়নশীল দেশগুলো। তাদের দাবি ছিল বছরে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু ধনী দেশগুলো টাকা বাড়াতে রাজি না হওয়ায় শনিবার বিকেলে সম্মেলন বর্জনের ঘোষণা দেয় উন্নয়নশীল ও ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো। পরে গভীর রাতে আবারও আলোচনায় ফেরে সবাই। অচলাবস্থা কাটিয়ে গতকাল ভোরে কিছু পরিবর্তন এনে চুক্তি অনুমোদন হয়।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস আশা করছেন, চুক্তিটি মেনে বাস্তবতার দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। এটি নির্মাণের ভিত্তি দিয়েছে। অবশ্যই সম্পূর্ণ এবং সময়মতো বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রতিশ্রুতিগুলো দ্রুত নগদায়ন করতে হবে।

নতুন সমঝোতায় তহবিলের অঙ্ক বাড়লেও তা যথেষ্ট মনে করছে না উন্নয়নশীল দেশগুলো। উন্নত দেশগুলোর কাছে স্পষ্ট বার্তা, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ তহবিলে এক পয়সাও দেবেন না। ফলে ৩০০ বিলিয়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সত্যিই কঠিন।
ভারত, সুইজারল্যান্ড, মালদ্বীপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, জীবাশ্ম জ্বালানির বৈশ্বিক ব্যবহার কমানোর বিষয়ে যে ভাষা চুক্তিতে ব্যবহার করা হয়েছে, তা খুবই দুর্বল। চুক্তির সমালোচনা করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার শিফট আফ্রিকার পরিচালক মোহামেদ আদোউ বলেছেন, উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য কপ২৯ একটি বিপর্যয়। ধনী দেশগুলো, যারা জলবায়ু পরিবর্তনকে গুরুত্ব দেওয়ার দাবি করে, তারাই ধরিত্রীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

 

আরও পড়ুন

×